এতদিন ধরে কট্টর হিন্দুত্ববাদী দল হিসাবেই পরিচিতি পেয়ে আসছিল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। অন্যদিকে মুসলিম তোষণ রাজনীতির অভিযোগ উঠে আসছিল মমতা ব্যনার্জির দল তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে পশ্চিমবঙ্গের এই দুইটি রাজনৈতিক দলের সেই চিরাচরিত রীতি থেকে সরে আসার ইঙ্গিত মিলেছে। রাজ্যের মুসলিমদের মন পেতে এবার কট্টর হিন্দুত্ববাদী অবস্থান থেকে সরে আসছে বিজেপি। আর দীর্ঘদিনের মুসলিম তোষণ নীতির অভিযোগ ঝেড়ে ফেলে হিন্দুদের দিকে ঝুঁকছে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল। সামনেই রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোট, আগামী বছর দেশটিতে লোকসভার নির্বাচন-একে সামনে রেখেই এখন থেকেই নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তনের লক্ষ্যে দুইটি রাজনৈতিক দলই সভা-সমাবেশ করে যাচ্ছে।
মুসলিম সমাজের কাছে নিজেদের ভাবমূর্তি ফেরাতে গতকাল বৃহস্পতিবার কলকাতার মহম্মদ আলি পার্কে বিশাল সমাবেশের আয়োজন করেছিল বিজেপির সংখ্যালঘু মোর্চা। যদিও এই সভার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন সদ্য তৃণমূল ছেরে বিজেপিতে যোগ দেওয়া মুকুল রায়। এছাড়াও ওই সমাবেশে হাজির ছিলেন দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ, দলের সংখ্যালঘু মোর্চার প্রধান আবদুল রশিদ আনসারি সহ মুসলিম নেতারা।
সমাবেশ থেকে সংখ্যালঘুদের প্রতি রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেসের সরকারকে অবহেলা-বঞ্চনার অভিযোগ তুলে দিলীপ ঘোষ বলেন ‘আমি দেখতে চাই তিনি (মমতা) ও তাঁর সরকার সংখ্যালঘুদের জন্য কি কি উন্নয়ন করেছে। গত ছয় বছরে মুসলিমদের জন্য কি পদক্ষেপ নিয়েছেন, মুসলমানদের কয়টা চাকরি হয়েছে?’
দিলীপের বক্তব্য, ‘নির্বাচন সামনে আসলেই তিনি (মমতা) বিজেপি নেতাদের ভিলেন বানিয়ে মুসলিমদের ত্রাতা হিসাবে নিজেকে জাহির করতে চান’। মমতাকে খোঁচা দিয়ে তিনি জানান, ‘কেবল ইমাম, মোয়াজ্জিনদের ভাতা দিয়ে আর হিজাব পরে মুসলমানদের উন্নয়ন হয় না। এ করে সস্তা জনপ্রিয়তা কুড়ানো যায় বা সাময়িক ভোট পাওয়া যায় কিন্তু প্রকৃত উন্নয়ন হয় না’।
২০১৪ সালের মে মাসে দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদির সরকার আসার পর থেকে উন্নয়নের যে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে তা উল্লেখ করে দিলীপ ঘোষ বলেন, মুসলিমদের উন্নয়নের ব্যাপারে বিজেপি সবসময়ই ঐকান্তিক-আমরা ‘সবার সাথে উন্নয়ন’এর ব্যাপারে বিশ্বাসী।
অন্যদিকে সভা থেকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী-কে নিশানা করে মুকুল রায় বলেন, ‘তিনি (মমতা) বলেছেন তিন তালাক বিরোধী বিল ভুলে ভরা...কিন্তু কেন এটা ভুল সেটা তিনি (মমতা) ব্যাখ্যা করেন নি। সংসদে যখন এই বিলটি নিয়ে আলোচনা হয়েছিল তার দল তখন নীরব ছিল’। রাজ্যের কয়েক লাখ বেকার যুবককে চাকরি দিয়েছেন বলে মমতা যে দাবি করেন সে প্রসঙ্গে মুকুল বলেন, ‘আমরা দেখতে চাই কাদের কাদের চাকরি দেওয়া হয়েছে..তার তালিকা আমাদেরকে দেওয়া হোক’।
মুকুলের দাবি ‘মহারাষ্ট্র, গুজরাট ও উত্তরপ্রদেশের মুসলিমরা বিজেপিকে সমর্থন করছে। তারা এও নিশ্চিত করেছে যে পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষরাও আগামী নির্বাচনে গেরুয়া শিবিরের প্রতি তাদের সমর্থন জানাবে’।
মুসলিম নেতা আবদুল রশিদ আনসারিও অভিযোগ তুলে জানান, ‘কংগ্রেস, বামফ্রন্ট, তৃণমূল কংগ্রেস-কেউই রাজ্যের সংখ্যালঘুদের জন্য কিছুই করেনি’।
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের রাজনতৈকি পরিস্থিতির এই পরিবর্তন কেন? বিশেষজ্ঞরা বলছেন পুরোটাই ভোট ব্যাংক কেন্দ্রিক! ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ মুসলিম। সেক্ষেত্রে নির্বাচনের ক্ষেত্রে মুসলিমরা সবসময়ই একটা বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায়। আর প্রতিটি রাজনৈতিক দলই জানে যে ক্ষমতায় থাকতে গেলে এই ভোটটি অত্যন্ত জরুরী। আর সেদিকে লক্ষ্য রেখেই বিগত বামফ্রন্ট সরকার এই ভোট ব্যাংক নিজেদের দিকে টানতে নানা কৌশল নিয়েছিলেন। বর্তমানে মমতার সরকারও সুকৌশলে সেই কাজ করেছে। আবার হাত গুটিয়ে বসে নেই বিজেপিও।
৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে ২০১১ সালে রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পরের বছর ২০১২ সালেই মুসলিমদের কাছে পেতে একাধিক পদক্ষেপ নেয় মমতার সরকার। ওই বছরের এপ্রিলেই ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের জন্য মাসিক ভাতা, তাদের সন্তানদের জন্য বিনামূল্যে জমি ও শিক্ষা দানের ঘোষণা করেন তিনি। নিজেকে মুসলিম দরদী প্রমাণ করতে সেসময় থেকেই বড় বড় হোর্ডিং’এ মাথায় হিজাব পড়া মমতা সহ তাঁর দলের অন্য নেতাদের মাথা ঢাকা ও দুই হাত জোড়া করা প্রার্থনার ছবিতে ঢেকে যায় কলকাতার ব্যস্ততম এলাকাগুলি। যা আজও দেখা যায় অনেক জায়গাতেই। মমতার এই মাথা ঢাকা ছবি নিয়ে কটাক্ষ করতে ছাড়েনি বিরোধীরাও। তাদের অভিমত এটা সংখ্যালঘু তোষণ ছাড়া কিছুই নয়। যদিও তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে মুসলিম তোষণ নয়, মমতার ওই ছবি ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবেশই বহন করে।
কিন্তু মমতার এই মুসলিম প্রীতির ফলে রাজ্যের একটা অংশ যে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে-সেটা সাম্প্রতি উপ-নির্বাচন (সবং কেন্দ্রে)-ই প্রমাণ। তাই নিজেদের গা থেকে ‘সংখ্যালঘু তোষণ’ শব্দবন্ধনী কৌশলে সরিয়ে রেখে এবার হিন্দুদের কাছে টানতে কৌশল নিয়েছে তাঁর সরকার। তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ ‘বাক্ষ্মণ ও পুরোহিত সম্মেলন’-যেটা এতদিন বিজেপির মজ্জাগত ছিল। গত সপ্তাহেই দলের তরফে বীরভূম জেলার বোলপুরে প্রায় ১৫০০ পুরোহিতকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। তাদের প্রত্যেককে গীতা, শাল, স্বামী বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব ও সারদা মা’এর একটি করে ছবি তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এছাড়া হিন্দুদের তুষ্ট করতেই বিভিন্ন জেলা সফরে গিয়ে মন্দির, মঠ-পরিদর্শন করছেন মমতা। অতি সম্প্রতি ‘গঙ্গাসাগর’ মেলা তীর্থযাত্রীদের দুর্ঘটনার কথা মাথায় রেখে তীর্থযাত্রীদের ব্যক্তিগত ‘জীবন বীমা’ করার ঘোষনা দিয়েছেন তিনি। গতকালও মেলার তীর্থযাত্রীদের শুভ যাত্রার জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে ট্যুইট করেছেন মমতা।
একদিকে তৃণমূল যেমন হিন্দুদের কাছে টানতে ময়দানে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, বিজেপিও তাদের গায়ের ওপর থেকে মুসলিম বিদ্বেষী তকমা ঝেড়ে ফেলতে জোর কদমে উঠে পড়ে লেগেছে। তারা বুঝেছে যে শুধুমাত্র হিন্দু ভোটের ওপর ভর করে পশ্চিমবঙ্গ দখল করা যাবে না। আর একথা মাথায় রেখেই সংখ্যালঘুদের দিকে মুখ ঘুরিয়েছে গেরুয়া শিবির। তাছাড়া তৃণমূল ছেরে মুকুলের বিজেপিতে যোগদানের পর থেকেই এই ধারা অব্যাহত। সম্প্রতি তাদের শক্তি বৃদ্ধি করেছে ইশরাত জাহান। তিন তালাক নিষিদ্ধ করার দাবিতে সুপ্রিম কোর্টে মামলাকারী চার নারীর মধ্যে একজন হলেন এই ইশরাত। তাঁর মতো একজন নারীকে দলে অন্তর্ভুক্তির মধ্যে দিয়ে দল বুঝিয়ে দিতে চায় যে তারা মুসলিম অছ্যুত নয়।
এদিকে তৃণমূলের এই হিন্দু প্রীতি নিয়ে কটাক্ষ করেছে রাজ্যের বিরোধী দলের নেতারা। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিরোধী দলনেতা কংগ্রেসের আবদুল মান্নান জানান ‘ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা দ্বারা পরিচালিত রাজনীতিটা একটা বিপজ্জনক প্রবণতা এবং এটা দীর্ঘদিন দিন ধরে চলা রাজ্যের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে নষ্ট করে দেবে’।
আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বামেরাও। সিপিআইএম-এর এমএলএ সুজন চক্রবর্তী বলেছেন ‘পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল ও বিজেপির এই প্রতিদ্বন্দ্বীমূলক সাম্প্রদায়িকতার ফল মারাত্মক হতে পারে। তৃণমূল সংখ্যালঘু মৌলবাদকে প্রশয় দিচ্ছে আর বিজেপি সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশয় দিচ্ছে। তৃণমূল এখন হিন্দুত্ব দিয়েই বিজেপিকে পরাস্ত করে নিজেদের ভাবমূর্তি উদ্ধারের খেলায় মেতেছে’।
যদিও তৃণমূলের সিনিয়র নেতা ও সাংসদ সৌগত রায় জানিয়েছেন বিভিন্ন সম্প্রদায়কে নিয়ে একসাথে চলাটাই তৃণমূলের নীতি। এর সাথে কোন একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে তুষ্ট করার বিষয় জড়িত নয়’।
বিডি প্রতিদিন/১২ জানুয়ারি ২০১৮/হিমেল