বৃহস্পতিবার, ২১ আগস্ট, ২০১৪ ০০:০০ টা

ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলা

ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলা

আত্মরক্ষা এবং বন্যপশু শিকারের জন্য লাঠির ব্যবহার আদিমকাল থেকেই মানুষ রপ্ত করেছিল। লাঠিখেলা শক্তি ও কৌশলের খেলা। শিকার ও যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে লাঠির ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছিল। সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় গ্রামীণ জোতদার বা জমিদাররা নদীর বুকে জেগে ওঠা চর দখল এবং নিজেদের সম্পদ রক্ষার জন্য লাঠিয়াল পোষণ করত। শিকার ও যুদ্ধক্ষেত্রে এর প্রয়োজনীয়তা ফুরালেও লাঠি নিয়ে শৌর্যবীর্য ও কলাকৌশল প্রয়োগের ক্ষেত্রে এখনো বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে। মূলত জোতদার ও জমিদারদের পোষ্য লাঠিয়াল বাহিনীর আধুনিক সংস্করণই আজকের লাঠিখেলা।

এক সময় লাঠিখেলা কিশোরগঞ্জের নানা অঞ্চলে ব্যাপকভাবে প্রচলন ছিল। নানা পালা-পার্বণ বিয়ের অনুষ্ঠান ইত্যাদি উপলক্ষে লাঠিখেলা অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। লাঠিখেলার অনুষ্ঠানে লাঠির ব্যবহার ছাড়াও গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত নানা জিনিস দিয়ে নানা রকম কসরত দেখিয়েও আনন্দ দান করার প্রয়াস লক্ষণীয়। এ ছাড়াও মহররম উপলক্ষে এখনো লাঠিখেলা অনুষ্ঠিত হয় এবং এটি মহররমের একটি অন্যতম আকর্ষণ। মহররমের লাঠিখেলায় কৃত্রিম যুদ্ধের মহড়া অনুষ্ঠান অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন অঞ্চলে এই খেলা অনুষ্ঠিত হলেও বিশেষ করে পাকুন্দিয়া, হোসেনপুর এলাকা এবং কিশোরগঞ্জ সদরের বৌলাই ও কাতিয়ারচরের লাঠিয়ালরাই বিশেষ কৃতিত্বের দাবিদার। একটা সময় ছিল যখন লাঠিয়ালরা খেলা দেখিয়েই জীবিকা নির্বাহ করত। সময়ের আবর্তে নানা টানাপড়েনে এখন জনপ্রিয় খেলা অত্যন্ত সীমিত হয়ে আসছে এবং খেলোয়াড়রা অন্য কাজে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছেন। কিশোরগঞ্জের অন্য এলাকার লাঠিখেলার প্রচলন বর্তমানে খুব একটা দেখা না গেলেও সদর উপজেলার বৌলাই এলাকার লাঠিয়ালরা এখনো তাদের পূর্ব পুরুষের পেশা ধরে রেখেছেন। সাধারণত ৯ জন সদস্য নিয়ে লাঠিখেলার দল গড়ে ওঠে বলে খেলোয়াড়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। এর মধ্যে একজন থাকেন দলনেতা, দলনেতাসহ কমপক্ষে পাঁচজন খেলোয়াড়, দুজন বংশীবাদক, একজন ঢোলবাদক ও একজন কর্তাল বাদক থাকেন।

বৌলাই এলাকার লাঠিখেলার সদস্য আবদুল হাই জানান, তার ওস্তাদ ছিলেন মহরম আলী। তার কাছ থেকেই তিনি লাঠিখেলা রপ্ত করেছেন। আর মহরম আলীর ওস্তাদ ছিলেন ফিরোজ আলী। ফিরোজ আলীর সহোদর করফুলার বাপ ওরফে করফুলা লাইঠ্যেল ছিলেন একজন নামকরা লাঠি খেলোয়াড়। মূলত ফিরোজ আলী ও করফুলা লাইঠ্যেল বৌলাই জমিদার বাড়ির লাঠিয়াল ছিলেন বলে জানা গেছে। তাদের নেতৃত্বে একটি বড় লাঠিয়াল বাহিনী বৌলাই জমিদার বাড়ির পেশাদার লাঠিয়াল ছিল।

জমিদারি প্রথা চলে যাওয়ার পর এই লাঠিয়ালরাই এটিকে লাঠিখেলায় রূপদান করেন। লাঠিখেলার রমরমা অবস্থা আগের মতো আর নেই। জীবিকার তাগিদে অনেকেই এ পেশা ছেড়ে চলে গেছেন অন্য পেশায়। যারা এখনো টিকে আছেন, তারা অন্য পেশায় থেকে এটিকে পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্য হিসেবে কোনোরকম ধরে রেখেছেন। খেলোয়াড়রা জানান, আগের মতো এখন আর লাঠিখেলার ডাক পড়ে না। এরপরও বিভিন্ন উৎসবে বৌলাইয়ের খেলোয়াড়দের ডাক পড়ে। তারা জানান, সাধারণত ঢাকায় লাঠি খেলতে গেলে তাদের ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। আর স্থানীয়ভাবে কোনো অনুষ্ঠানে তাদের দেওয়া হয় ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা। লাঠি খেলোয়াড় আবদুল হাই জানান, আগে বিয়ে, মুসলমানি বা অন্য যে কোনো অনুষ্ঠানে লাঠিখেলা ছাড়া অনুষ্ঠান জমতই না। এখন আর সেদিন নেই। তবুও বাপ-দাদার এ পেশাকে আমরা টিকিয়ে রেখেছি ঐতিহ্য হিসেবে।

 

 

সর্বশেষ খবর