বৃহস্পতিবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

গার্মেন্ট বন্ধের হিড়িক

গার্মেন্ট বন্ধের হিড়িক

বাংলাদেশের অন্যতম রপ্তানিযোগ্য পোশাক খাতে কিছুতেই স্থিতিশীলতা ফিরছে না। একের পর এক দুর্ঘটনা, শ্রমিক আন্দোলনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে অস্থির হয়ে উঠেছে পোশাক খাত। আর এ কারণে পোশাক খাতের সঙ্গে জড়িতরা এ ব্যবসা থেকে ক্রমেই হারিয়ে ফেলছেন উৎসাহ। এর ফলে বাংলাদেশে কারখানা বন্ধের হিড়িক পড়েছে। এ কারণে গত তিন মাসে প্রায় দুই লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। এ সময়ে ছোট-মাঝারি মিলিয়ে প্রায় ৪৫০টি পোশাক কারখানার মালিক নিজেদের কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন বলে পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সূত্রে জানা যায়। এর মধ্যে বিজিএমইএ কর্তৃপক্ষ তাদের সদস্যভুক্ত ২১৮টি কারখানার বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তারা আরও জানান, তাদের সদস্য নয় এমন আরও দুইশর অধিক কারখানা মালিক কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন। সব মিলিয়ে মোট ৪৫০ কারখানা বন্ধ হয়ে পড়েছে বলে বিজিএমইএ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। আর কারখানা বন্ধের কারণ হিসেবে তারা দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন-পূর্ববর্তী রাজনৈতিক সহিংসতা, মজুরি বৃদ্ধির জন্য উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া এবং কারখানার পরিবেশ নিয়ে ক্রেতাদের কঠোর মনোভাবকে চিহ্নিত করেন। তোবা গ্রুপের পাঁচটি গার্মেন্ট বন্ধের পর গত ১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মিরপুরের পূরবী সুপার মার্কেটের ইমাকুলেট প্রাইভেট লিমিটেড গার্মেন্ট বন্ধ করে দেন এ কারখানার মালিক। কারখানা শ্রমিকরা জানান, তারা কারখানা বন্ধের আগের দিন পর্যন্ত কাজ করেছেন। এর আগে মিরপুর ১২ নম্বরে আরও একটি কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। বিজিএমইএ সূত্রে জানা যায়, বন্ধ হওয়া কারখানাগুলোর মধ্যে ৪০ শতাংশ শেয়ার্ড বিল্ডিং কারখানা। এ বিষয়ে বিজিএমইএ সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রধানত নির্বাচনের আগের রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে অনেক বিদেশি ক্রেতা এ দেশ থেকে ভিয়েতনামে চলে যান। এখন অর্ডার মার্কেট কম। এ ছাড়া শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির কারণে কারখানাগুলোর উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির জন্য কারখানা মালিক অনেকেই বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। তা ছাড়া কমপ্লায়েন্ট ইস্যুতে ক্রেতারা এখন কঠোর হওয়ায় বহু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে এবং কিছু বন্ধের পথে রয়েছে। আর এ পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য এবং উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারকে কারখানাগুলোতে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ ও গ্যাস সুবিধা দিতে হবে বলে বিজিএমইএ সহসভাপতি জানান। তিনি আরও বলেন, এ অবস্থায় আমি শঙ্কিত। কারণ বড় কারখানাগুলো এ প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজারে টিকে গেলেও ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলো তা পারবে না। তোবা গ্রুপ শ্রমিক সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক ও শ্রমিক নেত্রী মোশরেফা মিশু বলেন, তোবা গ্রুপের কারখানা বন্ধের নোটিস আইনত অবৈধ। আমরা একে চ্যালেঞ্জ করে শ্রম আদালতে মামলা করতে যাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, কারখানা যদি লে-অফে যায় তবে বিদ্যমান শ্রম আইন মেনে কারখানা কর্তৃপক্ষকে শ্রমিকদের চাকরির প্রাপ্য সব সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। জানা যায়, খরচ কমাতে কারখানা মালিকদের অনেকেই এখন শ্রমিক ছাঁটাই করছেন। ঈদের আগেও বহু কারখানা বন্ধ করা হয়েছিল যার খবর বিজিএমইএ কর্তৃপক্ষ জানে না। তবে বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানাগুলো বেশির ভাগই ছোট ও মাঝারি ধরনের। আগে বড় কারখানাগুলো বেশি করে পোশাকের অর্ডার নিয়ে তা অন্য কারখানায় সাব-কন্ট্রাকের ভিত্তিতে করিয়ে নিত। কিন্তু রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর এখন বড় ক্রেতারা কারখানাগুলোর পরিবেশ ও মান যাচাই করে তবেই অর্ডার দেন। আর এ ক্রেতারা শেয়ার্ড বিল্ডিংয়ে অর্ডার নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। এক্ষেত্রে ছোট কারখানাগুলো কাজ না পেয়ে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। জানতে চাইলে বিজিএমইএর সহসভাপতি এস এম মান্নান কচি বলেন, বিদ্যমান শ্রম আইন অনুযায়ী কোনো মালিক যদি ব্যক্তিগতভাবে তার ব্যবসা চালিয়ে যেতে না পারেন তবে তিনি কারখানা বন্ধ করতে পারেন। সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রাজ্জেকুজ্জামান রতন বলেন, যে কারখানাগুলো এখন বন্ধ হচ্ছে সেগুলো সাব-কন্ট্রাক কারখানা। কিন্তু অন্য কারখানাগুলোর কাজের অভাব নেই। আমাদের দেশের পোশাক কারখানাগুলোর যে পরিমাণ যন্ত্রপাতি রয়েছে তা দিয়ে ৫০ বিলিয়ন ডলারের পোশাকের অর্ডার নেওয়া সম্ভব। আর এ অবস্থায় যদি বিজিএমইএ কর্তৃপক্ষ বলে তাদের অর্ডার কম, সে কথা গ্রহণযোগ্য নয়। কারখানা কমে এলেও এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে এখন ৪২ লাখ হয়েছে। আর এ শ্রমিকরা বড় কারখানাগুলোতে কাজ করছেন। এটি ঠিক যে বড় কারখানাগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ছোট কারখানাগুলো টিকতে না পেরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু শ্রম আইন অনুযায়ী কোনো কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে শ্রমিকদের চার মাসের বেতন ও গ্র্যাচুইটি দিতে হয়। কিন্তু শ্রমিকদের বঞ্চিত করার জন্য মালিকরা লোকসানের বাহানা দিয়ে কারখানা বন্ধ করে দিচ্ছেন। এরই মধ্যে নিরাপত্তা ইস্যুতে উত্তর আমেরিকা ভিত্তিক পোশাক ক্রেতাদের জোট অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স সেফটি (অ্যালায়েন্স) ও ইউরোপের আরেকটি জোট অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ (অ্যাকর্ড) কারখানা পরিদর্শনের পর ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার কারণে ২১টি কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে বিজিএমইএ সদস্যভুক্ত ৫ হাজার ৭৫১টি কারখানার মধ্যে সাড়ে তিন হাজার কারখানা চালু আছে। এর মধ্যে ডিহোল্ডার আছে দুই হাজার ২০০ কারখানা।
বিজিএমইএর ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম মান্নান কচি বলেন, গত ৬ মাসে ৪১৯টি কারখানায় জরিপ চালিয়ে আমরা দেখি যে নিজস্ব ভবন না থাকার কারণে বিদেশি ক্রেতারা ১১০ মিলিয়ন ডলারের (৫৪ কোটি ১৫ লাখ টাকা) কার্যাদেশ বাতিল করে। অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স কারখানা মালিকদের শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য ব্যয়বহুল সব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলছে। মালিকরা তা পূরণের চেষ্টাও করছেন। কিন্তু এ অবস্থায় তারা যদি অর্ডার ফিরিয়ে নেন তবে কীভাবে আমরা নিরাপত্তার ব্যবস্থা করব, আর কীভাবেই বা শ্রমিকদের বেতন দেব! অন্যদিকে মালিকদের নানারকম পরামর্শ দিলেও বিদেশি ক্রেতারা আমাদের পোশাকের মূল্য না বাড়িয়ে উল্টো কমানোর কথা বলছেন। তারা আফ্রিকা, ইথোপিয়ার মতো দেশ থেকে পোশাক ক্রয়ের কথাও বলছেন। বিজিএমইএ কর্তৃপক্ষ জানায়, মূলত যেসব পোশাক কারখানার নিজস্ব ভবন নেই, শেয়ার্ড ভবনে নিজেদের কারখানা চলাচ্ছে তাদের কাছ থেকেই বিদেশি ক্রেতারা অর্ডার ফিরিয়ে নিচ্ছেন। এরই মধ্যে অর্ডার না পেয়ে অনেক ছোট ও মাঝারি কারখানা মালিক কারখানা বন্ধের জন্য বিজিএমইএর কাছে করণীয় জানতে চেয়েছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর