রাজু আহমেদের কথা মনে পড়ে? স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ‘জল্লাদের দরবার’ শিরোনামে জনপ্রিয় ও মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধকারী নাটকে জল্লাদের ভূমিকায় যার বলিষ্ঠ ও ভরাট কণ্ঠস্বরে অনুষ্ঠানটি প্রাণবন্ত হয়ে উঠত! যার কণ্ঠস্বর শুনে মুক্তিযুদ্ধে শত্রু নিধনে উজ্জীবিত হতো বাংলার দামাল ছেলেরা- সেই শক্তিমান অভিনেতা রাজু আহমেদের কথা বলা হচ্ছে।
ষাট দশকের জনপ্রিয় এই অভিনেতাকে বাঁচতে দেয়নি ঘাতকরা। মানুষরূপী হায়েনাদের তপ্ত বুলেটে ৩৩ বছর বয়সী টগবগে এই যুবকের শরীর ঝাঁঝড়া হয়েছিল। ৪৩ বছর আগে বুলেটবিদ্ধ রাজু আহমেদকে চলে যেতে হয় না ফেরার দেশে। দেশের মানুষকে কাঁদিয়ে অনন্য এই প্রতিভা অকালেই ঝরে যায়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সর্বপ্রথম যে হত্যাকাণ্ডটি মানুষের মনে নাড়া দিয়েছিল, সেটি হলো অভিনেতা রাজু আহমেদের খুনের ঘটনা। ১৯৭২ সালের ১১ ডিসেম্বর নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর মানুষ হতবাক। শোকের ছায়া নেমে আসে সর্বত্র। যে মানুষটির কণ্ঠস্বর মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস জুগিয়েছিল, সেই অভিনেতাই নিষ্ঠুর খুনের শিকার হলেন স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে? এমন প্রশ্ন তখন ঘুরপাক খাচ্ছিল সর্বমহলে। কিন্তু সেই প্রশ্নের জবাব দীর্ঘ ৪৩ বছরেও পাওয়া যায়নি। রাজুর খুনিদের বিচার হয়নি। জিয়া সরকার আমলে বিচারের নামে হয়েছিল শুধু প্রহসন। সেই খুনি বাবলা, প্যারোট আজো আছে প্রকাশ্যে। রাজুকে হত্যার পর একই ঘাতকরা খুন করে অভিনেত্রী শিউলি আহমেদকে। ১৯৭৩ সালে অস্ত্রধারীরা শিউলি আহমেদকে গুলি করে হত্যার পর এসিড ঢেলে দিয়েছিল শরীরে। পর পর এই দুটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা মনে করতেই অনেকে এখনো শিউরে ওঠেন। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান। বলেন, খুনিরা আজও কীভাবে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায়। রাজধানীর মালিবাগ, শান্তিবাগ এলাকাতে খুনির দলটি এখনো বহাল তবিয়তে কীভাবে?
যেভাবে খুন হলেন রাজু আহমেদ : পুলিশ ও অন্যান্য সূত্র জানিয়েছে, ১৯৭২ সালের ১১ ডিসেম্বর রাজু আহমেদ এবং নাট্যকার, লেখক ও সাংবাদিক কল্যাণমিত্র রাজধানীর মালিবাগের সিদ্ধেশ্বরী গিয়েছিলেন অভিনেত্রী শিউলি আহমেদের বাসায়। ‘জল্লাদের দরবার’ নাটকটি চলচ্চিত্রে রূপ দিতে কাজ করছিলেন রাজু আহমেদ। ওই চলচ্চিত্রে কাজ করার অনুরোধ জানাতে শিউলি আহমেদের বাসায় যান তারা। কথাবার্তা শেষ করে তারা রাত ৮টার দিকে শিউলি আহমেদের বাসা থেকে বের হন। একটি রিকশায় চড়েন তারা। কিন্তু আগে থেকেই ওই স্থানে অস্ত্র নিয়ে ওতপেতে ছিলেন স্থানীয় বাবলা ও প্যারোটসহ আরও কয়েকজন। রাজু আহমেদকে দেখেই তাদের হাতের অস্ত্রগুলো তেঁতে ওঠে। ব্রাসফায়ার। গুলিবিদ্ধ হন রাজু আহমেদ, কল্যাণমিত্র এবং তাদের রিকশাচালকও। ঘাতকের নিশানায় থাকা রাজু আহমেদের শরীর ঝাঁঝড়া হয়। রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন তিনি। কিছু সময় পরই তার মৃত্যু ঘটে। রাত আনুমানিক ১০টায় রাজু আহমেদের অনুজ বঙ্গবন্ধুর প্রেসসচিব আমিনুল হক বাদশা নিজেই ভাইয়ের লাশ উদ্ধার করে নিয়ে যান বঙ্গবন্ধুর বাসায়। অপরদিকে হাতে গুলিবিদ্ধ কল্যাণমিত্র প্রাণে বেঁচে যান। গুলিবিদ্ধ রিকশাচালককে নিয়ে কল্যাণমিত্র হাসপাতালে যেতে সক্ষম হন। অস্ত্রধারীদের এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণে পুরো এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়। ঘটনা ঘটিয়ে অস্ত্রধারীরা দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়।
রাজু আহমেদ হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ তদন্ত শুরু করে। কিন্তু গাফিলতির কারণে তদন্ত এগোয় না। রাজু হত্যার বিচার পান না তার স্বজনরা। পরবর্তীতে মামলাটি সিআইডিতে স্থানান্তর করা হয়। খান মজলিশ এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন। জিয়া সরকার আমলে মার্শাল ল চলাকালে গ্রেফতার হন খুনি বাবলা ও প্যারোট। মাত্র চার থেকে পাঁচ বছর জেল খেটে তারা বেরিয়ে যান। রাজু আহমেদের পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এমন কয়েকজন জানান, রাজু আহমেদ হত্যার বিচার না পাওয়ায় পরিবারের সদস্যরা হতাশ। যোগাযোগ করা হলে রাজু আহমেদের ভাই জানান, যিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে জল্লাদের দরবারের মূল ভূমিকা জল্লাদের চরিত্রে অভিনয় করে ইয়াহিয়ার মুখোশ উন্মোচন করেছিলেন, তার মৃত্যুরই বিচার হলো না। এ রকম হত্যাকাণ্ড এরপর আমাদেও দেশে অসংখ্য ঘটেছে। আমাদের আর কতকাল এরকম হত্যাকাণ্ড দেখতে হবে? হত্যাকাণ্ড ঘটার এক মাসের ভিতরে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে কী বিচার করা যায় না? সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়টি ভেবে দেখার আহবান জানান তিনি। তিনি আরও বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য, রাষ্ট্রীয়ভাবে রাজু আহমেদকে কোনো সম্মাননা জানানো হয়নি। মরণোত্তর পদকও তো দেওয়া যেত। নাটকপাগল রাজু আহমেদ অল্প সময়ের মধ্যেই যোগ্য অভিনেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। ষাট দশকের সিনেমার একজন জনপ্রিয় খলনায়ক হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পান তিনি। এই উপমহাদেশের চলচ্চিত্রে ব্যতিক্রমধর্মী খলনায়কের মধ্যে রাজু আহমেদ অন্যতম। আর্ট কলেজে স্কলারশিপ নিয়ে তাকে পাকিস্তানে থাকতে হয়েছিল। অনন্য প্রতিভার অধিকারী রাজু আহমেদ মুক্ত স্বাধীন দেশে তার অভিনীত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান জল্লাদের দরবার চলচ্চিত্রে রূপ দিতে চেয়েছিলেন। সরকারের অনুদানে আবদুল্লাহ আল মামুনের পরিচালনায় এই ছবির মহরত আনুষ্ঠানও হয়েছিল হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে। উদ্বোধন করেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি তাজউদ্দীন আহমেদ। কিন্তু তার কয়েক দিন পরই রাজু আহমদকে আঁততায়ীর গুলির নিষ্ঠুর শিকার হতে হয়। দেশের মানুষকে কাঁদিয়ে অনন্য এই প্রতিভা অকালেই ঝরে যায়। রাজু আহমেদের জন্ম ১৯৩৯ সালে কুষ্টিয়ার আমলাপাড়ায়। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবি- ‘বাল্যবন্ধু’, ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, ‘মিশর কুমারী’, ‘কাঁচ কাটা হীরে’, ‘স্মৃতিটুকু থাক’, ‘আমার জন্মভূমি’, ‘কাঁচের স্বর্গ’, ‘অশান্ত ঢেউ’, ‘দুটি মন দুটি আশা’। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নাটক ‘জল্লাদের দরবার’-এ অভিনয় করে স্মরণীয় হয়ে আছেন রাজু আহমেদ। তিনি শুধু অভিনেতাই ছিলেন না, ছিলেন একজন শিল্পীও। তিনি ছবি আঁকতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে করাচিতে অনুষ্ঠিত চিত্রকলা প্রদর্শনীতে তার আঁকা একটি ছবি পুরস্কৃত হয়। তিনি নিহত হওয়ার পর তার কণ্ঠের অসমাপ্ত ডাবিংগুলো দারাশিকোর কণ্ঠ দিয়ে পূরণ করা হয়েছিল।
শিরোনাম
- সুন্দরবনে পুশইন ৭৮ জন, খাবার-ওষুধ দিয়ে সহায়তা কোস্টগার্ডের
- আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের রোডম্যাপ না আসায় ‘মার্চ টু যমুনা’ ঘোষণা
- জনগণ আওয়ামী লীগকে আর দেখতে চায় না : প্রিন্স
- মুন্সিগঞ্জ সদরে জমি নিয়ে বিরোধে ৪ জনকে কুপিয়ে জখম
- বরিশালে বইছে মৃদু তাপপ্রবাহ, জলীয় বাষ্পে গরম আরও অসহনীয়
- ‘পতিত পলাতক পরাজিত অপশক্তির পুনর্বাসন চায় না বাংলাদেশের মানুষ’
- কাকিনা-মহিপুর সড়কে ভারি যান চলাচল নিয়ে উত্তেজনা, মানববন্ধন
- রাজধানীতে মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড
- বলিউডে স্ক্রিপ্ট কি রেডি! আসছে ‘অপারেশন সিঁদুর’
- চট্টগ্রামে মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
- নেতানিয়াহুর সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ট্রাম্প : রিপোর্ট
- ‘রাজকুমার রাওয়ের স্ত্রী’ হিসেবে পরিচিতি পেতে ঘৃণা করি: পত্রলেখা
- রাজবাড়ীতে যৌথবাহিনীর অভিযানে অস্ত্রসহ আটক ২
- পুলিশের পিস্তল চোরকে ধরতে লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা
- ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো বিনোদনের মাধ্যমে পরিণত হয়েছে : প্রেস সচিব
- পাকিস্তানের আকাশসীমা বিমান পরিষেবার জন্য উন্মুক্ত
- যুদ্ধবিরতির কথা নিশ্চিত করলেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও
- সাবেক এমপি শামীমা ও শেখ হাসিনার সহকারী প্রেস সচিব বিটু গ্রেফতার
- বগুড়ায় আলোচিত সন্ত্রাসী ঝুমুর সরকার গ্রেপ্তার
- বিকাল ৫টা থেকে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে, জানালো ভারত
চাঞ্চল্যকর সেসব খুন (১২)
স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম খুন অভিনেতা রাজু আহমেদ
মির্জা মেহেদী তমাল
প্রিন্ট ভার্সন

এই বিভাগের আরও খবর
সর্বশেষ খবর

পাল্টা হামলা: ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র সংরক্ষণ কেন্দ্র ধ্বংসের দাবি পাকিস্তানের
১২ ঘণ্টা আগে | পূর্ব-পশ্চিম

পাকিস্তানের ‘অপারেশন বুনিয়ান-উন-মারসুস’, ভারতের ২৬ সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত
৮ ঘণ্টা আগে | পূর্ব-পশ্চিম