সোমবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

নবান্ন উৎসবে প্রাণের ছোঁয়া

মোস্তফা মতিহার

নবান্ন উৎসবে প্রাণের ছোঁয়া

কুয়াশার চাদরে এখনো ঢাকেনি শহর। এখনো শীতের আমেজে জবুথবু হয়নি শহরের মানুষ। কিন্তু গাঁয়ের ভোরের মেঠাপথে এখন কুয়াশার হিমশীতল পরশ। হেমন্তের শীতের পরশটা উপভোগ্য হয়ে ওঠে নবান্নেই। নতুন ধান ঘরে ওঠার আনন্দে এদিন কৃষাণ-কৃষাণিরা উদ্বেলিত হয় আনন্দের বাঁধভাঙা জোয়ারে। গ্রামবাংলায় অগ্রহায়ণের সকালের øিগ্ধতা জুড়িয়ে দেয় আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার আপাদমস্তক। এ দিনের রাঙা সকালের জন্য সারা বছর অপেক্ষা করে গাঁয়ের কৃষাণ-কৃষাণিরা। নতুন ধানের আনন্দ নগর জীবনের নাগরিকদের সুখের আবেশ দিতে না পারলেও মাটির টানে নগরবাসীও মেতে ওঠে নবান্ন উৎসবে।

অগ্রহায়ণের প্রথম সূর্য উদিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা আয়োজনে গতকাল রাজধানীসহ সারা দেশে উদযাপিত হয়েছে নবান্ন উৎসব। জাতীয় নবান্ন উৎসব উদযাপন পর্ষদের আয়োজনে নবান্নের মূল আয়োজন হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বকুলতলায়। সকাল ৬টায় চারুকলায় ভিড় জমাতে থাকে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। ‘এসো মিলি সবে নবান্নের উৎসবে’ স্লোগান নিয়ে সকাল ৭টা ১ মিনিটে শুরু হয় এবারের নবান্ন উৎসব। প্রিয়াংকা গোপের রাগ-সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে উৎসবের সূচনা ঘটে। নাচ-গান-আবৃত্তির মধ্য দিয়ে মেতে ওঠে উৎসব। শুধু তাই নয়, উৎসবস্থলে পিঠা-পুলি, মুড়ি-মুড়কি খেয়ে নবান্নের খাবারের স্বাদও নিয়েছে। মেয়েরা রঙিন শাড়ি পরে খোঁপায় ফুল গুঁজে, আর ছেলেরা পাঞ্জাবি পরে উৎসবে প্রাণের ছোঁয়ায় নিজেদের একাত্ম করে নেয়। উৎসবের শুরুটা হয় সুরের খেলা দিয়ে। নাচ, আবৃত্তি, কথামালা ও শোভাযাত্রা দিয়ে সাজানো হয় নবান্নের দুই পর্বের আয়োজন। সকালের আয়োজনে আবৃত্তি পরিবেশন করেন লায়লা আফরোজ। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ‘আমার সকল কথা’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন তিনি। আবৃত্তি পরিবেশন করেন কাজী মদিনা ও আহকামউল্লাহ। দলীয় সংগীত পরিবেশন করে আনন্দন-এর শিল্পীরা। ‘বকুল ফুল বকুল ফুল সোনা দিয়া হাত কেন বান্ধাইলি’ গানের সঙ্গে দলের পরিবেশনা আগতদের মনে প্রাণের সঞ্চার ঘটায়। ‘ঢেঁকি নাচে দাপুর দুপুর আর কি নাচে সই’ গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করে নটরাজ এর শিল্পীরা।

উৎসবের উদ্বোধন করেন শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। উৎসব উদযাপন পর্ষদের চেয়ারপারসন লায়লা হাসান, আহ্বায়ক শাহরিয়ার সালাম প্রমুখ এ সময় উপস্থিত ছিলেন। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, নবান্ন উৎসব আমাদের সর্বজনীন উৎসব। নবান্ন উৎসবে প্রতিবাদও আছে সেটা বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে, কৃত্রিমতার বিরুদ্ধে। আমরা কৃত্রিম হব না। সোনার বাংলাদেশ স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তুলব। লায়লা হাসান বলেন, নতুন প্রজন্মকে আমাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেই এ আয়োজন। উৎসবে ফরিদা পারভীন পরিবেশন করেন লালন সাঁইয়ের ‘আমি অপার হয়ে বসে আছি’, ‘মিলন হবে কত দিনে’ ও ‘তোমরা ভুলেই গেছ মল্লিকা দির নাম’। মহাদেব ঘোষ শোনান ‘আয়রে মোরা ফসল কাটি’, সন্দিপন শোনান ‘ফসলের সোনা মাঠে, নবান্ন এলো বাংলার ঘরে ঘরে’। উদীচীর শিল্পীরা পরিবেশন করেন ‘হায়রে কোথায় সোনার ধান/শূন্য খামার কাঁদে’, সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পীরা শোনান ‘আবার জমবে মেলা বটতলা’, বহ্নিশিখার শিল্পীরা শোনান ‘আহারে খুশি খুশি মন, নবান্নেতে রইল বন্ধু তোমায় নিমন্ত্রণ।

দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে স্পন্দন, নৃত্যম, নন্দন কলা কেন্দ্রের শিল্পীরা। গারো কালচারাল একাডেমির শিল্পীরা পরিবেশন করেন জুম নৃত্য। রাজশাহীর রঙ্গরস থিয়েটারের শিল্পীরা পরিবেশন করেন আলকাপ। মানজার চৌধুরী সুইটের সঞ্চালনায় প্রথম পর্বের পরিবেশনা শেষে সকাল ৯টায় বকুলতলা থেকে বের হয় নবান্ন শোভাযাত্রা। একই স্থানে বিকাল ৩টায় শুরু হয় উৎসবের দ্বিতীয় পর্বের অনুষ্ঠান। নানা সাংস্কৃতিক আয়োজনের মধ্য দিয়ে এ আয়োজন চলে রাত ৮টা পর্যন্ত। আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-লালমনিরহাট : নবান্নে জেলার বিভিন্ন গ্রামে দু দিনব্যাপী চলে জামাই আদরের ধুম ‘জামাই মেলা’। নতুন ধানের পিঠা-পুলিতে আপ্যায়ন করা হয় জামাইকে। নতুন ধান কাটা আর সে ধানের প্রথম অন্ন জামাইকে খাওয়ানোর মধ্য দিয়ে চলে জামাই মেলা। প্রথম দিনে জেলার শিয়াল খোওয়া গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে নতুন ধানের তৈরি পিঠা বাড়ির আঙিনায় আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের মধ্যে বিতরণ করছেন বয়োবৃদ্ধ শেফালী বেওয়া। তিনি জানালেন, প্রায় ৪৪ বছর পূর্ব থেকে নবান্ন এলেই এসব উৎসব তারা পালন করেন। জামালপুর : প্রথম দিনে নবান্ন উৎসব ও পিঠা মেলা হয়েছে। জেলা প্রশাসন ও শিশু একাডেমির আয়োজনে গতকাল সকালে শহীদ মিনার চত্বরে নবান্ন উৎসবে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা, রাজনীতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দ ছাড়াও নানা স্তরের শহরবাসী অংশ নেয়। আদমদীঘি (বগুড়া) : সকাল থেকে আদমদীঘি উপজেলার বেশকিছু গ্রামে ঘুরে দেখা গেল নবান্ন উৎসব। প্রতি বাড়িতে জড়ো হয়েছে মেয়েজামাই, নাতি-নাতনি ও নিকটাত্মীয়। গ্রামের প্রতিটি পাড়া-মহল্লা ও মোড়ে মোড়ে বসেছে চুড়ি-ফিতা, আলতা ও শিশুদের খেলার সামগ্রী এবং জিলাপি, রসগোল্লা, চমচম, বাতাসা, মুড়কি ও পাপড় ভাজাসহ মুখরোচক নানা পণ্যের মেলা। নওগাঁ : বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, পিঠা উৎসব ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নবান্ন উৎসব পালিত হয়েছে। নালিতাবাড়ী : শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলায় শোভাযাত্রা, ছড়ার আসর, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নবান্ন উৎসব উদযাপিত হয়েছে। পৌর শহরের সেঁজুতি বিদ্যা নিকেতনে সকালে উৎসবের উদ্বোধন করেন কৃষাণি কল্পনা চিরান। পরে একটি শোভাযাত্রা পৌর শহরের প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। বেলা ১১টায় নবান্ন কথন নামে আলোচনা সভা, দুপুর ১২টায় ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের নিয়ে হয় ছড়া গানের আসর। বিকালে স্থানীয় শিল্পীদের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও সন্ধ্যায় বাউলগান অনুষ্ঠিত হয়।

সর্বশেষ খবর