রবিবার, ১০ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

পেশাভিত্তিক চাঁদাবাজি যেন বৈধ উৎসব

মানিক মুনতাসির, পাবত্যাঞ্চল থেকে ফিরে

পেশাভিত্তিক চাঁদাবাজি যেন বৈধ উৎসব

প্রকাশ্য দিবালোকে বৈধ চাঁদাবাজির উৎসব চলছে পার্বত্যাঞ্চলজুড়ে। মহল্লার টং দোকান, বাজারের মুদি দোকান, কৃষক, শ্রমিক, ট্রলার মালিক, চালক— সবাইকে চাঁদা দিয়ে নিজ নিজ পেশায় টিকে থাকতে হয় পাহাড়ি এ অঞ্চলে। শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যই নয়, স্থানীয় বাজারে কৃষিপণ্য বেচতে গেলেও জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) এবং ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) সন্ত্রাসীদের চাঁদা দিতে হয়। এমনকি যারা চাকরিজীবী তাদেরও নিয়ম কারে চাঁদা গুনতে হয় প্রতি মাসে। শুধু তাই নয়, চাঁদা পরিশোধের রশিদও দেওয়া হয় সংশ্লিষ্টদের। চাঁদা না দিলে প্রাণে মেরে ফেলা হয়। কিংবা পরিবারের সদস্যদের ধরে নিয়ে গহীন জঙ্গলে শারীরিকভাবে অত্যাচার করা হয়। ফলে প্রাণ ভয়ে আর পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তার কথা ভেবে পার্বত্যাঞ্চলের এই চাঁদা যেন বৈধতা পেয়ে গেছে। চাঁদার ক্ষেত্রে আবার এর হারেও হেরফের রয়েছে। উপজাতিদের চেয়ে বাঙালিদের রেট বেশি। কেউ কোনো প্রতিবাদও করে না। বছরের পর বছর নীরবে চাঁদা দিয়ে যাচ্ছেন পাহাড়ি অঞ্চলের এসব অসহায় মানুষ।

সরেজমিন জানা গেছে, ভুক্তভোগীরা স্থানীয় থানায় হরহামেশা এ ধরনের চাঁদাবাজির অভিযোগ করেন। কিন্তু এর কোনো প্রতিকার হয় না। কারণ ওই চাঁদাবাজদের টিকিও ধরতে পারে না পুলিশ। তবে পুলিশ প্রশাসন তাদের লোকবলের সংকটের কারণে অসহায়ত্বের কথা অকপটে স্বীকার করেছেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে। বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলার শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, স্থানীয় পর্যায়ে তাদের থানাগুলোর লোকবল থাকে ৩০ জনের মতো। এর মধ্যে কর্মকর্তা লেবেলের থাকে ২ থেকে ৩ জন। এ ছাড়া ঐ সব দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা এতটাই খারাপ যে, সন্ত্রাসীদের আস্তানা পর্যন্ত পৌঁছার আগেই তারা নিরাপদস্থলে চলে যায়। বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও চট্টগ্রাম অঞ্চল ঘুরে এসব তথ্য জানা গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেএসএসের মুখপাত্র ও সহপ্রচার সম্পাদক সজীব চাকমা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘জেএসএসের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমরা চাঁদাবাজি করি না। পাহাড়িদের কল্যাণে কাজ করি। তাদের আদায় করা চাঁদার রশিদ বাংলাদেশ প্রতিদিনের হাতে রয়েছে এ কথার প্রত্যুত্তরে তিনি বলেন, সেটা জেএসএসের নামে অন্য কেউ করতে পারে। আমাদের নয়। স্থানীয় পর্যায়ের একাধিক গোয়েন্দা সূত্র জানায়, চার জেলায় দৈনিক প্রায় দেড় কোটি টাকার চাঁদা তোলে উপজাতিদের সশস্ত্র গ্রুপগুলো। তাদের দেওয়া তথ্যমতে, সামান্য কলার ছড়া থেকে শুরু করে, ব্যবসা-বাণিজ্য, জেলে, খামার, ঠিকাদারি, উন্নয়নমূলক সব কাজ থেকে নির্দিষ্ট হারে চাঁদা দিতে হয়। সূত্রমতে, চাঁদা আদায়ে নিয়োজিত রয়েছে জেএসএস ও ইউপিডিএফের পাঁচ হাজার সশস্ত্র প্রশিক্ষিত কর্মী। সরকারের করের ন্যায় বিভিন্ন জিনিসের ওপর মাসিক/বার্ষিক নির্দিষ্ট হারে চাঁদা আদায় করা হয় এবং রসিদও দেওয়া হয়। ক্যাডার পর্যায়ে নিয়োগপ্রাপ্ত এসব সশস্ত্র সদস্যের বেতন-ভাতাও দেওয়া হয় বলে বলে জানা গেছে। সরেজমিন গিয়ে জানা গেছে, চাঁদার ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা রেটও বলবৎ রয়েছে এ অঞ্চলে। এ ক্ষেত্রে গাছে প্রতি ঘনফুট ও বাঁশে প্রতি শ’ হিসেবে চাঁদা আদায় করা হয়। আর কলার প্রতি কাঁদি। শ্রমিকদের দৈনিক আয়। ট্রলার মালিক ও শ্রমিকের বেলায়ও দৈনিক আয়ের ভিত্তিতে চাঁদা দিতে হয়। অর্থাৎ যার যত বেশি আয় তাকে তত বেশি পরিমাণ চাঁদা দিতে হয়। বর্তমানে প্রতি ঘনফুট সেগুন গোল গাছে জেএসএসকে চাঁদা দিতে হয় বছরে ৪০ টাকা, ইউপিডিএফকে দিতে হয় ৫০ টাকা। এভাবে সেগুন রদ্দা, গামারী গোল-রদ্দা, লালি গোল-রদ্দার ওপর আলাদা আলাদা হারে চাঁদা ধার্য করা হয়েছে।

প্রতি ১০০ বাঁশে বছরে জেএসএস-ইউপিডিএফ উভয়েই চাঁদা আদায় করে ৪০০ টাকা করে। এভাবে বাইজ্জা বাঁশের জন্য রয়েছে আলাদা রেট। প্রথম শ্রেণির মাছ ব্যবসায়ীদের জেএসএসকে বছরে চাঁদা দিতে হয় ৪০ হাজার, ইউপিডিএফকে ৫০ হাজার। এভাবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির ব্যবসায়ীদের আলাদা আলাদা হারে চাঁদা গুনতে হয়। সূত্র আরো জানায়, বিভিন্ন ধরনের মাছ ধরার জালের ওপর আলাদা আলাদা হারে বার্ষিক (নয় মাসে বছর) চাঁদা আদায় করা হয়। কেসকি জাল (১ হাজার বামের ওপর) থেকে জেএসএস আদায় করে বছরে ছয় হাজার টাকা। ইউপিডিএফ সাত হাজার। এভাবে ধর্ম জাল, টেংরা জাল, কুত্তা জাল, ভাসা জাল, টেইনা জাল, লুই জাল, নাইট জাল ও বড়শির ওপর পৃথক হারে চাঁদা আদায় করে তারা। তাদের এই চাঁদার আওতায় বাদ পড়েনি কলার ছড়াও। প্রতি ছড়ার জন্য বর্তমানে জেএসএসকে ছয় টাকা ও ইউপিডিএফকে দিতে হয় ১০ টাকা। এ ছাড়া গরু-ছাগল বিক্রির ওপর যথাক্রমে জেএসএস ১২ ও ৬ শতাংশ এবং ইউপিডিএফ দুইশ ও এক’শ হারে চাঁদা আদায় করে। রাঙামাটি জেলার বিলাইছড়ি, খাগড়াছড়ির সাজেক ও নীল আঁচলের স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন বাজার ঘুরে জানা গেছে, বাঁশ, বেত, কাঠ, ছন সংগ্রহ, বেচাকেনা ও পরিবহন, কৃষি-খামার, ক্ষুদ্র-মাঝারি ব্যবসা-বাণিজ্য, সড়ক ও নৌপথে মালামাল পরিবহন থেকে শুরু করে ঠিকাদারি, অবকাঠামো নির্মাণ কাজ সবকিছুর ওপর থেকেই জোরপূর্বক চাঁদা আদায় করে জেএসএস ও ইউপিডিএফ। এমনকি কলা, আদা, হলুদ, আনারস, লেবু, কমলা, খাদ্যশস্য চাষাবাদ, গবাদিপশু-পাখি বেচাকেনা করতে গিয়েও চাঁদা পরিশোধ করতে বাধ্য হচ্ছেন পার্বত্য এলাকার বাসিন্দারা। গত ২২ জুন পার্বত্য চট্টগ্রামের সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি ফিরোজা বেগম চিনু রাঙামাটি শহরে তার বাসভবনে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় শান্তি চুক্তি করা হয়েছে। এর বাস্তবায়নও করছে সরকার। কিন্তু পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা তাদের গোষ্ঠীগত জেদ থেকে সন্ত্রাসী কার্যকম থেকে বেরিয়ে আসছে না। চাঁদাবাজির বিষয়গুলো অনেক আগে থেকেই স্বীকৃত। এ ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসনকে আরো জোরালো ভূমিকা রাখার পরামর্শ দিয়েছেন এই সংসদ সদস্য।

সর্বশেষ খবর