বৃহস্পতিবার, ২৬ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা
দুই মেয়রের সাতকাহন

বরিশাল সিটি চলে কার ইশারায়

রাহাত খান, বরিশাল

বরিশাল সিটি চলে কার ইশারায়

আহসান হাবিব কামাল বরিশাল সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত মেয়র হলেও তার ছেলে কামরুল আহসান রূপন সিটি করপোরেশনের সব কিছুতে হস্তক্ষেপ করেন বলে সর্বত্র অভিযোগ আছে। টেন্ডার ভাগবাটোয়ারা, পছন্দের ঠিকাদারদের বিল ছাড়, সিটি করপোরেশনে অভ্যন্তরীণ বদলি-পদোন্নতি সব কিছু হয় রূপনের ইশারায়। এ কারণে রূপন ‘ছায়া মেয়র’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন বরিশালে। কামাল মেয়র নির্বাচিত হওয়ার আগে তার ছেলে রূপন ঢাকার গাজীপুরে পারিবারিক ফিডমিল দেখাশোনা করতেন। কিন্তু বাবা মেয়র হওয়ার পর তিনি বরিশালে স্থায়ী হন। সিটি করপোরেশনে একতরফা ঠিকাদারি করে গত প্রায় ৪ বছরে অঢেল টাকার মালিক হয়েছেন তিনি। নির্বাচনের আগে ফিডমিলের নামে কামালের ৪ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ থাকলেও প্রথম বছরেই ওই ঋণ পরিশোধ করেন তিনি। সম্প্রতি ফিডমিলটি ৫ কোটি টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। যদিও মেয়রপুত্র রূপনের দাবি তাদের ফিডমিল বিক্রি হয়েছে ৮ কোটি টাকায়।

এ ছাড়া মেয়র কামাল ও তার ছেলে ইউসিবিএল ব্যাংকের শেয়ার হোল্ডার। ছেলে রূপন ডেইরি ফার্ম করেছেন নগরীর নবগ্রাম রোডে। ওই ফার্মে কাজ করানো হয় সিটি করপোরেশনের কর্মচারীদের দিয়ে। যান্ত্রিক বিভাগের কাজ নিয়ন্ত্রণ করেন মেয়রের জামাতা শামীম হাসনাইন কাজল। মেয়রপুত্র রূপন এবং মেয়রের এপিএস ফরিদউদ্দিনের ব্যবহৃত ব্যক্তিগত মোটরসাইকেলের জ্বালানি তেল দেওয়া হয় সিটি করপোরেশন থেকে। এ ছাড়া বরিশালে ঢাকা ব্যাংক (হিসাব নং-২১৭২০৩২৯৩), মার্কেন্টাইল ব্যাংক, পূবালী, রূপালী, ইউসিবিএল, সাউথইস্ট এবং ব্যাংক এশিয়ায় কোটি কোটি টাকা লেনদেন করছেন কামাল ও তার পুত্র রূপন। ঢাকায় ডিওএইচএস (ওল্ড) ৫ নম্বর রোডে ছেলে ও জামাতা শামীম হাসনাইন কাজলের নামে দুটি ফ্ল্যাট কিনেছেন কামাল। দেড় কোটি টাকায় কেনা নতুন প্রাডো জিপ প্যাকেট অবস্থায় রাখা হয়েছে। অথচ মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নগরভবন থেকে ঘুষ-দুর্নীতি নির্মূলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কামাল। কিন্তু দায়িত্ব নেওয়ার পর নিজেকে পাল্টে ফেলেন তিনি। সিটি করপোরেশনের প্রতিটি উন্নয়ন কাজে মেয়রের ১২ ভাগ হারে কমিশন আদায় নগর ভবনে ‘ওপেন সিক্রেট’। মন্ত্রণালয়ে পার্সেন্টেজ দিয়ে বরাদ্দ আনতে হয় দাবি করে সবার কাছ থেকে ১২ ভাগ হারে কমিশন আদায়ের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ ছাড়া প্রধান প্রকৌশলী, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, নির্বাহী প্রকৌশলী, সহকারী প্রকৌশলী ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী পদে পদোন্নতিতে কোটি টাকার উপরে ঘুষ লেন-দেনের বিষয়টি সিটি করপোরেশনের সবার মুখে মুখে। নগর ভবনের প্রধান ব্যক্তি দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ায় সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল শাখা, হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণ ও আদায় শাখা, হাট-বাজার ইজারা ও স্টল বরাদ্দ শাখা, রিকশা ও অটোরিকশার লাইসেন্স নবায়ন, ট্রেড লাইসেন্স শাখা, হিসাব শাখা এবং পানি সরবরাহ শাখায় বকশিশ ছাড়া কোনো কাজ হয় না। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শাখায় কাগজে কলমে এক হাজার ৬০০ দৈনিক মজুরি ভিত্তিক কর্মচারী থাকলেও বাস্তবে কাজ করছে প্রায় ৫০০। দৈনিক ২৫০ টাকা হারে ১ হাজার ১০০ শ্রমিকের নামে বরাদ্দ উঠিয়ে আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে মেয়রের বিরুদ্ধে। অবশ্য বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের কর্মকর্তা দীপক লাল মৃধাও এই টাকার ভাগ পেয়ে থাকেন বলে কর্মরত শ্রমিকরা জানিয়েছেন। এ ছাড়া প্রতি বছর মশক নিধনে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও পানি মেশানো ওষুধ স্প্রে করে বাকি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ আছে দায়িত্বশীলদের বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগের ব্যাপারে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একাধিক তদন্ত কমিটি তদন্ত করে। তবে মন্ত্রণালয়ের আমলা, বরিশাল অঞ্চলের প্রভাবশালী একজন মন্ত্রী, জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতার পরিবার এবং স্থানীয় এমপিকে ম্যানেজ করে এসব অভিযোগ ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

সিটি করপোরেশনের কর্মচারীরা গত ৬ মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না। কয়েক মাস পরপর এক-দুই মাসের বেতন দেওয়া হলেও আবার বকেয়া পড়ে যায় ৫-৬ মাসের। এ কারণে বকশিশের টাকার ওপর নির্ভর করে সংসার চলে বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। আবার যেসব শাখায় কমিশন আদায়ের সুযোগ কম সেসব শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংসার চলে কষ্টে। কর্মচারীরা বেতন না পেলেও সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী পুলিশ লাইন রোডের নবাব স্টেটে এবং তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ডা. এহতেশামুল হক নাসিম বিশ্বাস সড়কের পাশে বহুতল ভবন নির্মাণ করছেন। সম্প্রতি নগরীর পুরান পাড়ায় সিটি করপোরেশনের জমি প্লট করে নামমাত্র মূল্যে ঘনিষ্ঠজনদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন মেয়র। এ নিয়ে কাউন্সিলরদের ক্ষোভ রয়েছে। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার আগে পৌর চেয়ারম্যান থাকাকালে ৩৪ লাখ টাকার দুর্নীতি মামলাটি উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ এনেছেন তিনি। সার্বিক বিষয়ে মেয়র আহসান হাবিব কামাল বলেন, ৫৯ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সিটি করপোরেশন এলাকার উন্নয়নে যে অর্থের প্রয়োজন হয়, তার সবটুকু সরকার থেকে না পেলেও কিছু বরাদ্দ পাচ্ছেন। এই বরাদ্দ দিয়ে নগরবাসীকে সন্তুষ্ট করা সম্ভব নয়। তারপরও নগর উন্নয়ন এবং নগরবাসীর সেবায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন থেকে এখন পর্যন্ত ঘুষ-দুর্নীতি পুরোপুরি ঝেড়ে ফেলা সম্ভব হয়নি। তবে অনেকাংশ নিয়ন্ত্রণ হয়েছে। বাকিটুকুও আগামী ২-১ মাসের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে। মেয়রপুত্র সিটি করপোরেশন চালায় নগর আওয়ামী লীগের এমন অভিযোগের বিষয়ে কামাল বলেন, এগুলো রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক বক্তব্য। এর সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই। বরিশালে সিটি করপোরেশনের নাগরিক সেবার বিষয়ে সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক এম. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, কামাল জেনুইন ভোটে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। যারা তাকে ভোট দিয়েছেন, তারাও জানেন তার কি যোগ্যতা আছে, তিনি কি করতে পারবেন। তিনি বলেন, মেয়র যথেষ্ট কৌশলী। আগের মেয়রের অর্জন টুকুতে নতুন কিছু সংযোজন করতে পারেননি তিনি। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা নেই। তিনি সবার মুখ বন্ধ করে রাখার কৌশল নিয়েছেন।

সর্বশেষ খবর