বুধবার, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

শৈশবেই হয়ে উঠছে সহিংস, অসামাজিক

জিন্নাতুন নূর

শৈশবেই হয়ে উঠছে সহিংস, অসামাজিক

ধানমন্ডির তানিমা-রাশেদ দম্পতির ছয় বছরের ছেলে জিসান। বাসায় কেউ বেড়াতে এলেই শিশুটি লুকিয়ে পড়ে। সমবয়সী বাচ্চাদের সঙ্গেও তেমন মিশতে চায় না। কেউ আদর করতে গেলেই কেঁদে ওঠে। মা-বাবা ছেলেকে নিয়ে মনোচিকিৎসকের কাছে গিয়ে জানতে পারেন যে, ভাইবোন না থাকায় এবং চাকরিজীবী মা-বাবার ব্যস্ততার কারণে পরিবারের অন্য সদস্যের সঙ্গ না পাওয়ায় জিসানের আচরণে এই পরিবর্তন এসেছে।

ব্যাংক কর্মকর্তা মাহবুব-রুমকির পাঁচ বছরের ছেলে সোহান অল্পতেই রেগে যায়। মা-বাবা শাসন করলেই ঘরের জিনিস ছুড়ে ফেলে সে। সোহানের কথা না শুনলেই চিৎকার করে, অন্য বাচ্চাদের খামচি ও কামড় দেয়। এত অল্প বয়সেই সন্তানের এত রেগে যাওয়ার কারণ নিয়ে বেশ চিন্তিত সোহানের মা-বাবাও। সমাজবিজ্ঞানীরা জানান, শিশুদের সৌজন্যবোধেও আগের চেয়ে পরিবর্তন এসেছে। পাড়া-মহল্লায় ছোট ছেলেমেয়েদের এখন প্রকাশ্যেই ধূমপান করতে দেখা যায়। বড়দের সঙ্গে দেখা হলেও তাদের সালাম দেওয়া ও কুশল বিনিময় করতে দেখা যায় না। বড়দের সামনেই মেয়েদের সঙ্গে অশালীন আচরণ করছে ছোট ছেলেরা। ছোটখাটো ঝগড়া বাধলে কিশোররা সহিংসতায় জড়াচ্ছে। অর্থাৎ সার্বিকভাবে শিশু-কিশোরদের মধ্যে মূল্যবোধ তৈরি হচ্ছে না, তারা হয়ে উঠছে সহিংস এবং অসামাজিক। মনোবিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে শিশু-কিশোর ও তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের আচরণে উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটছে। সামাজিক মূল্যবোধহীন সমাজে বেড়ে ওঠা ছেলেমেয়েরা ক্রমেই অস্থির ও সহিংস হয়ে উঠছে। বড়দের সম্মান করা কিংবা অভিভাবকদের নির্দেশ মেনে চলার মানসিকতা অধিকাংশ শিশুর মধ্যে নেই। আর এগুলো হচ্ছে রাজনৈতিক ও পারিবারিক অস্থিরতা, প্রযুক্তির অপব্যবহার, অভিভাবকদের অবৈধ সম্পত্তি, সুস্থ বিনোদনের অভাব, শিক্ষাব্যবস্থার বিভাজন, অভিভাবকদের সময় না পাওয়া ও অসৎ সঙ্গের কারণে। শিশুদের মধ্যে যাতে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি না হয় এ জন্য সংশ্লিষ্টরা বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। তাদের মতে এই পরিস্থিতি প্রতিরোধে রাজনৈতিকদের সঠিক ভূমিকা পালন করতে হবে। রাষ্ট্রের নজরদারি বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। পরিবারের সদস্যদের তাদের সন্তানদের সঙ্গে নিয়মিত ভাবের আদানপ্রদান করতে হবে। সর্বোপরি পারিবারিক পরিমণ্ডলে ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শিশু-কিশোরদের আচরণে পরিবর্তনের জন্য দীর্ঘমেয়াদি মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা প্রয়োজন। শিশুদের জন্য শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয় হচ্ছে তার পরিবার। কিন্তু এখন সেই পরিবারেই অনেক অবক্ষয় ঘটছে। উচ্চবিত্ত পরিবারের অভিভাবকরা সন্তানদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা জোগান দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকেন। আর খোঁজখবর রাখেন না। এমনকি দেশে সুস্থ বিনোদনের যথেষ্ট অভাব। ছেলেমেয়েদের সংস্কৃতি ও শরীরচর্চার কোনো সুযোগ নেই। এ ছাড়া আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসনের কারণেও ছেলেমেয়েদের আচরণে নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটছে। মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, শিশুদের মধ্যে এখন মূল্যবোধ তৈরি হচ্ছে না। শৈশবেই চলচ্চিত্র থেকে তাদের মধ্যে নেতিবাচক ধারণার জন্ম নিচ্ছে। এর উত্তরণে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় বিভাজন বন্ধ করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইউনিফর্ম পরতে হবে, সেই সঙ্গে রাজনৈতিকদের মধ্যে সচেতনতা আনতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাদেকা হালিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মা-বাবার ব্যস্ততার জন্য শিশুরা এখন অভিভাবকদের সঙ্গে নিজেদের অনুভূতি ভাগাভাগি করতে পারে না। অন্যদিকে বিত্তশালী অভিভাবকদের সন্তানদের দেখাদেখি মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানদের মধ্যেও কৃত্রিম চাহিদা তৈরি হচ্ছে। যা তাদের আচরণে পরিবর্তন আনছে।

সর্বশেষ খবর