শিরোনাম
রবিবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

বালু লুটে জোট আওয়ামী লীগ-বিএনপির

কুষ্টিয়ায় রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার

জহুরুল ইসলাম, কুষ্টিয়া

কুষ্টিয়ায় নদ-নদীর কোটি কোটি টাকার বালু হরিলুটে একজোট হয়েছেন কতিপয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতা। পদ্মা ও গড়াই নদীর ২১টি বালু মহাল দখলে নিয়ে তারা প্রতিদিন হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। এই লুটপাটে ব্যবহার করা হচ্ছে এসকাবিটার মেশিন ও ড্রেজার। ফলে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পদ্মা ও গড়াই নদীর নাব্য রক্ষার কথা বলে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সহযোগিতায় বিএনপি নেতা আনোয়ারুল হক মাসুম বিআইডব্লিউটিএ থেকে ৩০ লাখ ঘনফুট বালু উত্তোলনের অনুমতি নেন। পরে উপজেলা প্রশাসন ২০০৯ সালে এ বিষয়ে দরপত্র আহ্বান করতে গেলে মাসুম হাই কোর্টে রিট করেন। ২০০৯ সালেই ৩০ লাখ ঘনফুটের কথা বলে কয়েক গুণ বেশি বালু উত্তোলন করে নিয়ে যাওয়া হয় বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড তার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। কিন্তু রিটের সুবাদে বিএনপি নেতা মাসুমের নামে বছরের পর বছর ধরে বালু কাটা হচ্ছে। মাসুমকে কমিশন দিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের নেতারাও এখন বালু মহাল লুটেপুটে খাচ্ছেন। শহরতলির জুগিয়া বালু মহালে গিয়ে দেখা গেছে, নদী পাড়ে একের পর ট্রাক এসে বালু বোঝাই করে নিয়ে যাচ্ছে। শ্যালো ইঞ্জিন চালিত ট্রলিতে করেও নেওয়া হচ্ছে বালু। পাড়ে বসে জনৈক বাবুসহ কয়েক ব্যক্তি ট্রাক থেকে টাকা আদায় করছেন। বড় ট্রাক থেকে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা, আর ছোট ট্রলি থেকে নেওয়া হচ্ছে ৭০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত। বালু মহালের কয়েকজন নিয়ন্ত্রক দম্ভ করে এ প্রতিনিধিকে বলেন, ‘কুষ্টিয়ার বড় বড় রাঘব-বোয়াল এ ঘাটের পেছনে আছে।’ স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্থানীয় পৌর কাউন্সিলর মহিদুল এ বালু মহালটি নিয়ন্ত্রণ করেন। প্রতিদিন এ ঘাট থেকে ৩০০ থেকে ৪০০ ট্রাক বালু ওঠে। তার লোকজন এসব ট্রাক থেকে টাকা আদায় করে। আরও জানা গেছে, মহিদুল এক সময় বিএনপি করতেন। এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বহু অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। সম্প্রতি আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। বিএনপি নেতা মাসুমের নাম ব্যবহার করে এ ঘাটটি তিনি এক হাতে নিয়ন্ত্রণ করছেন। প্রতি মাসে বালু ঘাট থেকে যে আয় হচ্ছে— তার বড় একটি ভাগ আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের কয়েক নেতাকে দিতে হচ্ছে তাকে। এলাকায় তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পান না। মহিদুল বালু উত্তোলনের কথা স্বীকার করে এ প্রতিনিধিকে বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমি আপনাকে কোনো বক্তব্য দেব না।’ এদিকে কুষ্টিয়া-রাজবাড়ী মহাসড়কের লাহিনী এলাকায় গড়াই নদী থেকে অবাধে কাটা হচ্ছে বালু। সেখানেও যুবলীগ কর্মী বিদ্যুৎ বিএনপি নেতা মাসুমের নাম ব্যবহার করে ঘাটটি নিয়ন্ত্রণ করছেন। ঘাটে বসে প্রকাশ্যে তিন-চার ব্যক্তি ট্রাক থেকে টাকা আদায় করছেন। তারা বলেন, ‘এ ঘাটের পেছনে বড় বড় সব মাথা আছে।’ আওয়ামী লীগ, যুবলীগের কয়েকজন নেতা ও স্থানীয় চেয়ারম্যান জড়িত বলে তারা জানান। এর মধ্যে জেলা যুবলীগের দুই শীর্ষ নেতাও রয়েছেন। ঘাটের ম্যানেজারের দায়িত্বে থাকা মোক্তার ও কবির নামে দুই ব্যক্তি জানান, বিএনপি নেতা মাসুম ঢাকায় থাকেন। তিনি টাকার একটি অংশ পান। তার কাজ আদালত দেখা। মোক্তার এ সময় জানান, স্থানীয় আওয়ীমী লীগ ও যুবলীগের কয়েকজন নেতা ছাড়াও চাপড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এ ঘাট থেকে নিয়মিত টাকা পান। ঘাটের কোনো কাগজপত্র আছে কি না— জানতে চাইলে তারা তা বলতে পারেননি। এ বিষয়ে জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক রবিউল ইসলাম জানান, ‘আাামাদের নাম কেন আসছে? এসব ঘাটের সঙ্গে আমাদের দলের ছোটখাটো কেউ হয়তো থাকতে পারে। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।’ অনুসন্ধানে আরও দেখা গেছে, এ এলাকায় বড় দুটি সেতুর পিলারের পাশ থেকেও মাটি ও বালু তুলে নিচ্ছে প্রভাবশালীরা। পাশেই নদীতে অবৈধ ড্রেজার ও ইঞ্জিন লাগিয়ে পাইপ বসিয়ে বালু তুলে নিয়ে যাচ্ছেন খোকন নামের এক ঠিকাদার। পাইপ দিয়ে কয়েক কিলোমিটার দূরে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের কাজে এসব বালু ব্যবহার করা হচ্ছে। অবৈধভাবে এসব বালু তোলা হলেও সরকারের কাছ থেকে বিল তুলছেন ঠিকাদাররা।

কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জাহেদুল ইসলাম বলেন, ‘নদী ড্রেজিংয়ের লাখ লাখ ঘন ফুট বালু পাড়ে রাখা ছিল। সে সব বালু প্রভাবশালীরা বিক্রি করে দিচ্ছেন। ৩০ লাখ ঘনফুট বালু উত্তোলনের কথা বলে প্রভাবশালীরা কোটি কোটি ঘনফুট বালু নিয়ে চলে যাচ্ছেন। এ জন্য উচ্চপর্যায়ের তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।’ কুষ্টিয়া জজ কোর্টের সরকারি কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট আক্তারুজ্জামান মাসুম বলেন, ‘একটি চক্র উচ্চ আদালতে ভুয়া রিট করে বালু মহাল দখলে নিয়ে কোটি কোটি টাকা কামিয়ে নিচ্ছেন। আনোয়ারুল হক মাসুম, আবু সাঈদ ও টনি বিশ্বাসের সঙ্গে আরও অনেকে মিলে এসব ভোগদখল করছে। এরই মধ্যে উচ্চ আদালতে তারা আপিল করেছেন। বেশ কিছু রিট আদালত খারিজ করে দিয়েছে। প্রভাবশালী এ মহলটি একটি রিট খারিজের পর আবার রিট করে। এ কারণে সরকার ইচ্ছা থাকলেও ইজারা দিতে পারছে না। এ বিষয়ে ভূমি ও আইন মন্ত্রণালয় থেকে একজন বিশেষ আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।’ জেলা প্রশাসক মো. জহির রায়হান বলেন, ‘হাই কোর্টে রিট থাকায় বালু মহালগুলো ইজারা দেওয়া যাচ্ছে না। যে যার ইচ্ছামতো বালু তুলে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি দ্রুত এ বিষয়টি সমাধান করার জন্য।’ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী বলেন, ‘দলের নাম ভাঙিয়ে কেউ অপকর্ম করলে তার দায় দল নেবে না। বালু মহাল থেকে কারা ভাগ খায়— আমি জানি না। তবে কেউ জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে দল ব্যবস্থা নেবে।’

সর্বশেষ খবর