মঙ্গলবার, ১৪ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

শ্রমিকদের ঢাল বানাতে চায় মালিকরা

আদালতের রায় হাজারীবাগের সব ট্যানারি সরাতে হবে ৩১ মার্চের মধ্যে

নিজস্ব প্রতিবেদক

হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তর ঠেকাতে শ্রমিকদের ঢাল বানাতে চান মালিকরা। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পর আগামী ৩১ মার্চের মধ্যে সব ট্যানারি সাভারে নিতে হবে। কিন্তু এই সময়ের মধ্যেও তারা সাভারে ট্যানারি স্থানান্তর করতে রাজি নন। বারবার সময় বৃদ্ধি, আদালতে রিট করে কোনো কাজ না হওয়ায় ট্যানারি মালিকরা এবার কারখানা লে-অফ ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। লে-অফ ঘোষণা করলে ট্যানারি শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রায় দেড় লাখ শ্রমিক বেকার হতে পারে। এই শ্রমিকদের রাস্তায় নামিয়ে দিতেই নতুন পরিকল্পনা নিয়েছেন তারা। এ ছাড়া স্থানান্তর ঠেকাতে বা সময় বাড়াতে ট্যানারি মালিকদের দুই সমিতির নেতারা দৌড়ঝাঁপ করছেন সরকারি বিভিন্ন মহলের কাছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তারা দেখা করার চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেখা করে স্থানান্তরে সময় বৃদ্ধির আবেদন জানাবেন নেতারা। ট্যানারি মালিকদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সাভারে স্থানান্তর করে কারখানা চালুর জন্য ইউটিলিটি এখনো দেওয়া হয়নি। বিসিকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ট্যানারি মালিকরা সাভারে না যেতেই বেশি আগ্রহী।

জানা গেছে, সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত আদেশের পর গতকালও তারা ট্যানারি চালু রেখে চামড়া প্রক্রিয়াকরণের নানা কাজ করেন। আনা-নেওয়া চলে চামড়ার চালান। ট্যানারি এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, কাঁচা চামড়া এখনো আসছে। বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা কাজও করছেন। আর কোনো আইনি সুযোগ না থাকায় ট্যানারি মালিকরা বাধ্য হয়েই সর্বোচ্চ আদালতের আদেশ মেনে নিয়েছেন। আদালতের আদেশের পর মালিকদের দুই সমিতি মতবিনিময় সভা করে। দুই সংগঠনের নেতারা ট্যানারি বন্ধের আদেশ ঠেকাতে আর কোনো আইনি প্রক্রিয়া আছে কি না তা নিয়ে আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাদের আইনজীবীরা এ আদেশ পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) বা অন্য কোনো আইনি প্রক্রিয়া নেই জানিয়ে দেওয়ার পর গতকাল তারা আরেকটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দুই সংগঠন মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কারখানা লে-অফ ঘোষণা করার। একই সঙ্গে সব কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। এ সিদ্ধান্ত এক সপ্তাহের মধ্যে জানিয়ে দেওয়া হবে। নোটিস আকারে তা সব কারখানার গেটে ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে বিভিন্ন শ্রমিক পর্যায়ে কথা বলছেন তারা। শ্রমিকদের রাস্তায় নামিয়ে মিছিল-সমাবেশ করানোর চেষ্টা চলছে। ট্যানারি মালিকরা দুটি উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে এ চেষ্টা করছেন। প্রথমত তারা চেষ্টা করছেন সব শ্রমিক রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করলে সরকার স্থানান্তরে সময় বৃদ্ধি করবে; দ্বিতীয়ত, সাভারে স্থানান্তর করতে যে খরচ হবে এর পুরোটাই সরকারের কাছ থেকে আদায় করা যাবে। একই সঙ্গে সুদমুক্ত নতুন ব্যাংক ঋণ সুবিধা দেওয়ার দাবি জানাবেন তারা। ঢাকার পরিবেশ রক্ষায় ট্যানারিশিল্প হাজারীবাগ থেকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে হাই কোর্ট ২০০১ সালে রায় দেয়। ২০০৩ সালে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সরাতে ২০০৩ সালে সাভারে চামড়া শিল্প নগর প্রকল্প নেওয়া হয়। এক হাজার ৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে সাভারের হেমায়েতপুরের হরিণধরা গ্রামে প্রায় ১৯৯ একর জমিতে শুরু করা হয় চামড়া শিল্প নগর গড়ে তোলার কাজ। পরে ২০০৯ সালের ২৩ জুন আদালত এক আদেশে ২০১০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে হাজারীবাগের ট্যানারিশিল্প স্থানান্তরের নির্দেশ দেন। সরকারের আবেদনে এ সময়সীমা কয়েক দফা বাড়ায় আদালত। সর্বশেষ ২০১০ সালের ৩০ অক্টোবর ছয় মাস সময় বাড়ানো হয়। আদালতের এই সময় ২০১১ সালের ৩০ এপ্রিল শেষ হয়। এর পরও হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সরানো হয়নি। আদালতের অনুমতি ছাড়াই সরকার ট্যানারি মালিকদের দফায় দফায় সময় দেয়। সর্বশেষ আগামী ৩১ মার্চের মধ্যে সব ট্যানারি সরিয়ে নিতে সরকার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে। সরকারের এ সিদ্ধান্তের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ৩ জানুয়ারি হাই কোর্টে আবেদন করে বেলা। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ৬ মার্চ আদালত আদেশ দেয়, ৩১ মার্চের মধ্যে হাজারীবাগের সব কারখানা বন্ধ করে দিতে। জানতে চাইলে বিসিক চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসাইন ভূঁইয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ট্যানারি মালিকরা যদি কারখানা বন্ধ করে দেন তাতে তাদের লোকসান হবে বেশি। বহুবার তাদের সময় বৃদ্ধি করা হয়েছে। তারা বলছেন গ্যাস সংযোগ দিতে। এ জন্য আবেদন করতে হয়, ডিমান্ড নোট দিতে হয়। অনেক কারখানা গ্যাস সংযোগের জন্য আবেদনই করেনি। যারা আবেদন করেনি তারা কোন যুক্তিতে সময় বৃদ্ধির কথা বলছে! তিনি বলেন, মালিকরা বলছেন ক্ষতিপূরণের জন্য। তা দেওয়া হয়েছে। যে অংশ দেওয়া হয়নি তার জন্য নীতিমালা আছে। নীতিমালা না মেনে আগেই টাকা দিন—এটা কোনো যুক্তি হতে পারে না। তাদের ধারণা, সময় বাড়াতেই থাকবে। কিন্তু তা হবে না। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আদালতের ওপর শতভাগ আস্থা ও সম্মান রেখে আমাদের করণীয় ঠিক করছি। কারখানা লে-অফ ঘোষণা করা ছাড়া আমাদের হাতে আর কোনো সুযোগ নেই। কেবল লে-অফ ঘোষণা করাই নয়, আমাদের শ্রমিক ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্তও নিতে হবে। কারখানা না চললে তাদের বেতন-ভাতা দিতে পারব না।’ তিনি বলেন, ‘ইউটিলিটি সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলে আমাদের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। এতে ৪০০ মিলিয়ন ডলারের যে অর্ডার আছে তা বাতিল হয়ে যাবে। দেশে যে ১৫০টি রপ্তানিমুখী জুতার কারখানা গড়ে উঠেছে, তাদেরও চামড়া সরবরাহ করা যাবে না। এতে তাদেরও রপ্তানি আদেশ বাতিল হবে। এ অবস্থায় কারখানা লে-অফ ঘোষণা করা ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় থাকবে না।’

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর