বুধবার, ১১ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

নিম্নমানের কাগজে ছাপা হচ্ছে পাঠ্যবই

এনসিটিবির অপকর্মে ক্ষুব্ধ মুদ্রণশিল্প মালিকরা
আগামী শিক্ষাবর্ষে পাঠ্যবইয়েরমান নিয়ে শঙ্কা

রুহুল আমিন রাসেল

আবারও নিম্নমানের কাগজে পাঠ্যবই ছাপছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এতে ক্ষুব্ধ মুদ্রণশিল্প মালিকরা। নতুন শিক্ষাবর্ষে সময়মতো বই ছাপার কাজ শেষ করা নিয়ে তৈরি হয়েছে একাধিক জটিলতা। জানা গেছে, এর ফলে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়ার সরকারি চেষ্টাও বিফলে যাওয়ার আশঙ্কা।

সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, প্রাথমিক স্তরের বই মুদ্রাকরদের একাধিক অসৎ চক্র অধিক মুনাফার লোভে নিম্নমানের কাগজে ছাপিয়ে চলেছে। পরিণামে পাঠ্যবইয়ের মানও হবে অত্যন্ত খারাপ। এর নেপথ্যে রয়েছে নিম্নমানের কয়েকটি কাগজকল, যারা প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত ১ হাজার টন পাল্পও আমদানি করেনি, তারাই এবার এনসিটিবির মুদ্রাকরদের শত শত টন কাগজ সরবরাহ করছে। ওই কাগজেই ছাপানো হচ্ছে বই। তবুও এনসিটিবি কিংবা এনসিটিবি-নিযুক্ত পরিদর্শন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এখনো প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের কোনো বই বাঁধাই করে মাঠপর্যায়ে পৌঁছানো হয়নি। অথচ সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী এই সময়ে অর্ধেক বই দেশের সব উপজেলায় পাঠানোর কথা। আবার নবম-দশম শ্রেণির প্রায় ২ কোটি বই ছাপার দরপত্র প্রক্রিয়াই শেষ হচ্ছে না।

এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা অবশ্য গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সময়মতো শিক্ষার্থীদের হাতে সব বই পৌঁছে দিতে পারবেন। তিনি বলেন, ‘ইতিমধ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ৩০ শতাংশ বই মাঠ পর্যায়ে চলে গেছে। সুখপাঠ্য বইয়ের দরপত্র চূড়ান্ত না হলেও দু-এক দিনে হবে। এ বইও সময়মতো পৌঁছে যাবে। তার পরও কোনো প্রতিষ্ঠান যদি বই সরবরাহে ব্যর্থ হয়, তাদের জরিমানা করা হবে।’ বইয়ের কাগজের মান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এনসিটিবির কর্মকর্তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই ছাড়পত্র দিচ্ছেন।’ এনসিটিবি আগামী শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক (প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি) স্তরের ১০ কোটি ৩৬ লাখের কিছু বেশি ছাপছে। ২০টি প্যাকেজের আওতায় ৯৮টি লটে দেওয়া এই দরপত্রে বই ছাপার কাজ পেয়েছে দেশের বিভিন্ন মুদ্রাকর প্রতিষ্ঠান। জানা গেছে, দরপত্রের বিধি-নির্দেশের (স্পেসিফিকেশন) পরোয়া না করে নিম্নমানের কাগজে ছাপার কারণেই কয়েক বছর ধরে বই মানসম্মত হচ্ছে না। এনসিটিবি কাগজের ব্রাইটনেস, ডি-ইংকিং ও ভার্জিন পাল্প দ্বারা উৎপাদন সম্পর্কিত শর্ত দেয় তা মেনে স্থানীয়ভাবে মানসম্পন্ন কাগজ উৎপাদন সম্ভব নয়। তাই প্রাথমিক স্তরের বই মুদ্রাকররা নিম্নমানের কাগজে ছাপানোর জন্য বিভিন্ন অজুহাত তুলে মুদ্রণকাজ বিলম্বিত করার কৌশল নিয়েছেন। ইতিমধ্যে এই চক্রগুলো ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে পাঁচ দিনের ধর্মঘট করে বই ছাপার মেয়াদ ২৯ নভেম্বর থেকে ১৪ দিন বাড়িয়ে নিয়েছে (ধর্মঘটের কারণে ক্ষতি হওয়া পাঁচ দিনসহ)। এনসিটিবির একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা এদের ইন্ধন দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের কাছে নির্ধারিত সময়ে পৌঁছে দেওয়ার স্বার্থে সরকার শেষ মুহূর্তে স্পেসিফিকেশন-বহির্ভূত নিম্নমানের কাগজে ছাপা বই গ্রহণে বাধ্য হবে। এই অসাধু মুদ্রণকারীরা জানেন এভাবে সময় পিছিয়ে পিছিয়ে ছাপার কাজ ডিসেম্বরে নিতে পারলে শেষ পর্যায়ে যে কোনো উপায়ে বই ছাপিয়ে মাঠ পর্যায়ে পাঠানোই এনসিটিবির জন্য চ্যালেঞ্জ হবে। তখন আর কাগজের মান ঠিকমতো হলো কিনা, তা নিয়ে এনসিটিবির প্রশ্ন তোলার সুযোগ থাকবে না। অসাধু মুদ্রণকারীরা এনসিটিবির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে এই কারবার করছেন বছরের পর বছর। নিম্নমানের বই সরবরাহ করা সত্ত্বেও এনসিটিবির পক্ষ থেকে আগে কখনই মুদ্রণকারীদের বিল আটকে রাখা বা বিল কেটে নেওয়ার নজির নেই। এবারও সে ভরসায় নিম্নমানের কাগজে বই ছাপানো হচ্ছে। এনসিটিবি সূত্র জানায়, এবার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের দিয়ে নবম-দশম শ্রেণির বাংলা, ইংরেজি, বিজ্ঞান, গণিতসহ ১২টি পাঠ্যবই পরিমার্জন করে সুখপাঠ্য করা হয়েছে। এজন্য এই ১২টি বিষয়ের ১ কোটি ৯৮ লাখ বই ছাপানোর কাজ পৃথক দরপত্রে করা হচ্ছে। কিন্তু এসব বই ছাপার দরপত্র প্রক্রিয়াই শেষ করতে পারছে না এনসিটিবি। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মুদ্রণশিল্প সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এনসিটিবি এখনো সুখপাঠ্য বইয়ের দরপত্র চূড়ান্ত করতে পারেনি। অযোগ্য প্রতিষ্ঠানকে যদি এনসিটিবি দরপত্র দেয়, তাহলে হ-য-ব-র-ল যা হওয়ার তাই হবে। প্রাথমিকের বইয়ের মানহীন কাগজ ব্যবহার ও বাঁধাই নিয়ে যা হচ্ছে, সেই অপকর্মের সঙ্গে এনসিটিবির কিছু অসাধু কর্মকর্তা জড়িত। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে, এই অনিয়মগুলো তদন্ত করা।’ এনসিটিবি সূত্র জানায়, আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত প্রায় ৪ কোটি ৩৭ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য মোট ৩৫ কোটি ১৩ লাখ ২৬ হাজার ২০৭টি বই ছাপা হচ্ছে। এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরের ১০ কোটি ৩৬ লাখের কিছু বেশি বই ছাপা হচ্ছে। এ বই ছাপা নিয়ে এবার শুরু থেকেই ঝামেলা হচ্ছে। ২০১৬ সালের মতো এবারও সিন্ডিকেট করে প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে প্রায় ৪০ কোটি টাকা কম দর দিয়ে প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবই ছাপার কাজ নিয়েছে ৩২টি মুদ্রাকর প্রতিষ্ঠান। প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ২৭৭ কোটি টাকা কিন্তু কাজ করা হবে ২৩৭ কোটি টাকায়। এর মধ্যে কয়েকজন আছেন যারা একাধিক প্রতিষ্ঠানের নামে কাজ পেয়েছেন, যাদের একাধিক প্রতিষ্ঠান এর আগে ঠিকমতো বই না দেওয়ার অপরাধে জরিমানা দিয়েছে। জানা গেছে, এবার নিজস্ব সক্ষমতা ছাড়াই কিছু মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া এবং নবম ও দশম শ্রেণির জন্য সুখপাঠ্য করা ১২টি বিষয়ের বই ছাপানোর কাজের দরপত্র নিয়ে জটিলতার কারণে এবার পাঠ্যবই ছাপা নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়েছে। ফলে সময়মতো বই দেওয়া যাবে না। জানা গেছে, নিয়ম অনুযায়ী চুক্তির ৮৪ দিনের মধ্যে প্রাথমিকের বই ছাপিয়ে মাঠ পর্যায়ে পাঠানোর কথা। বিদ্যালয়ে বই দেওয়ার আগে সেগুলো মাঠ পর্যায়ে গুদামে রাখা হয়। পরে সেখান থেকে বিদ্যালয়ে বই যায়। প্রাথমিক স্তরের বই ছাপার চুক্তি হয় গত ১৭ জুলাই। কিন্তু দরপত্র প্রক্রিয়া শেষ করে চুক্তির ৩৪ দিন পর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর পরিদর্শন সংস্থা নিয়োগ করে। দরপত্র মোতাবেক কাজ নিলেও এখন মুদ্রাকররা বলছেন, দরপত্র অনুযায়ী প্রাথমিক স্তরের বই বাঁধাইয়ের কাজ করতে গেলে নির্ধারিত সময়ে কাজ দেওয়া সম্ভব হবে না। দরপত্র অনুযায়ী প্রাথমিক স্তরের বইগুলো আলাদা কাগজে র‍্যাপিং করে বাঁধাই করে মাঠ পর্যায়ে পাঠানোর কথা। মুদ্রাকররা এটি করতে গেলে বর্তমানের চেয়ে আট গুণ বেশি সময় লাগবে। এজন্য তারা চাইছেন শুধু ফিতা দিয়ে বাঁধাই করে বইগুলো পাঠাতে। অথচ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর বলছে, বই যাতে নষ্ট না হয় সেজন্যই আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী র‍্যাপিং করে বাঁধাই করার শর্ত দেওয়া হয়েছে।

সর্বশেষ খবর