সোমবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

বাংলাভাইদের গ্রেফতারে পুরস্কৃত নয়, চাকরিচ্যুত

মির্জা মেহেদী তমাল

বাংলাভাইদের গ্রেফতারে পুরস্কৃত নয়, চাকরিচ্যুত

মানুষের নিরাপত্তা ও জানমাল রক্ষার শপথ নিয়ে পুলিশের চাকরিতে ঢুকেছিলেন শফিকুল ইসলাম সাজু। তিনি তার শপথ রেখেছেন। কিন্তু তার এই শপথ রাখার মূল্য দিতে পারেনি রাষ্ট্র। বাংলাদেশে জেএমবি উত্থানের তথ্য সর্বপ্রথম তিনিই প্রকাশ্যে এনেছিলেন। জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলেন ভয়ঙ্কর জঙ্গিদের সঙ্গে। গ্রেফতার করেছিলেন বাংলাভাইয়ের মতো শীর্ষ জঙ্গি নেতাদের। মামলার বাদীও ছিলেন তিনি। সাহসী এই পুলিশ কর্মকর্তা পুরস্কৃত হওয়ার পরিবর্তে চাকরি হারিয়েছেন। চাকরি ফিরে পেতে পুলিশ দফতরে, মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। অনেকের আশ্বাসে নতুন করে বুক বেঁধেছেন। পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তারা চাকরি ফেরতের আশ্বাস দিয়ে তার কাছ থেকে জঙ্গিবিষয়ক তথ্য নিয়ে নিজেরা শুধু বাহবা কুড়িয়েছেন। কিন্তু শফিকুলের কথা কেউ মনে রাখেননি। দিন যায় মাস যায়, বছর গড়ায়-চাকরি আর ফেরত পান না এই পুলিশ কর্মকর্তা। এক সময়ের সাহসী পুলিশ কর্মকর্তা এখন শতবর্ষী মা, দুই সন্তান-স্ত্রী নিয়ে ঢাকায় মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। চাকরি হারানো এই পুলিশ কর্মকর্তার প্রশ্ন, জীবনবাজি রেখে জঙ্গিদের গ্রেফতার করাই কি ছিল আমার অপরাধ? তবে কেন আমাদের শপথ করানো হয়? সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুলিশের দুঃসাহসিক কাজের জন্য পুরস্কৃত করার রেওয়াজ রয়েছে। কিন্তু সেই পুরস্কারের পরিবর্তে যদি চাকরি কেড়ে নেওয়া হয়, তবে ভালো কাজ করার আগে পুলিশ বার বার চিন্তা করবে। ভালো কাজ পুুলিশের কাছ থেকে পাওয়াটা কঠিন হবে। উল্লেখ্য, দশ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার ঘটনার দুই নায়ক পুলিশের দুই সার্জেন্টকে পরবর্তীতে চরম হয়রানির শিকার হতে হয়েছিল। চাকরি হারানোসহ মামলার আসামি পর্যন্ত করা হয়। যদিও পরবর্তীতে চাকরি ফেরত পান সেই দুই সার্জেন্ট। ২০০৩ সালের ১৪ আগস্ট। গভীর রাতে পুলিশের কাছে খবর আসে-জয়পুরহাট জেলার ক্ষেতলাল থানা এলাকার মহেশপুর গ্রামের মন্তেজার রহমানের বাড়িতে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ চলছে। সারা দেশ থেকে জঙ্গিরা সমবেত হয়েছে সেই বাড়িতে। এমন খবর পেয়ে সদর থানা পুলিশ জেলা পুলিশের নির্দেশনায় সেই গ্রামে অভিযান চালায়। যদিও এলাকাটি ছিল ক্ষেতলাল থানা এলাকার। সদর থানার ওসি ইকবাল শফি ও একই থানার এসআই শফিকুল ইসলাম সাজুর নেতৃত্বে ১০-১২ জন অভিযানে অংশ নেয়। গভীর রাতে মন্তেজার রহমানের বাড়ির প্রাচীর টপকিয়ে প্রবেশ করে বাড়ির দরজা খুলে দেন এসআই শফিকুল। পুলিশের দল বাড়ির ভিতর প্রবেশ করেই হতবাক। বাড়ির মধ্যে ২৫০-৩০০ মানুষ। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায়, পার্বত্য জেলা ছাড়া বাংলাদেশের সব জেলা থেকে তারা এসেছে। উদ্দেশ্য ধর্ম প্রচার। কিন্তু পুলিশ জানতে পারে ২-৩ দিন ধরে তারা সেখানে অবস্থান করে জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল। স্বল্পসংখ্যক পুলিশ হওয়ায় তাদের আটক করাটা কঠিন হয়ে পড়ে। ওসি ফোনে এসপির সঙ্গে কথা বলেন। এসপি তাদের কৌশলে আটকে রাখতে বলেন। অতিরিক্ত পুলিশ পাঠানো হবে বলে এসপি আশ্বাস দেন। কিন্তু দীর্ঘ সময়ে পুলিশ আসে না। জঙ্গিরাও বুঝতে পারে পুলিশের কৌশল। তারা সেখান থেকে চলে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুুলিশের সঙ্গে বচ্সা হয়। এক পর্যায়ে তারা পুলিশের ওপর হামলা চালায়। ওসির মাথা ফেটে যায়। ছিনিয়ে নেয় ওয়াকিটকি। এসআই শফিকুল সঙ্গীয় ফোর্সদের নিয়ে জঙ্গিদের গ্রেফতারে তৎপর হয়ে ওঠেন। শুরু হয় বন্দুকযুদ্ধ। আতঙ্ক তখন চারদিকে। স্বল্পসংখ্যক পুলিশ জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করতে থাকে। দুই কনস্টেবল আহত হলে জঙ্গিরা তাদের শটগান ছিনিয়ে নেয়। অতিরিক্ত পুলিশ ইতিমধ্যে চলে আসে। পাকড়াও হয় শীর্ষ জঙ্গিদের ৩৩ জন। বাকিরা পালাতে সমর্থ হয়। ঘটনাস্থল থেকে লাঠি, নিষিদ্ধ বই, বাংলাদেশের সব জঙ্গির নামের তালিকা, চাঁদা আদায়ের রশিদসহ প্রায় ২০০-২৫০টি ট্রাভেল ব্যাগ জব্দ করা হয়। ক্ষেতলাল থানায় হাজির হয়ে এসআই শফিকুল বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলা নম্বর-৬(৮)২০০৩। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে আতাউর রহমান সানি (জামালপুর), ছিদ্দিকুর রহমান বাংলাভাই (বগুড়া), মামুনুর রশিদ (গাইবান্ধা) ও আবদুল আউয়াল (নাটোর)-সহ ময়মনসিংহের ত্রিশালে পুলিশের ভ্যান থেকে পলাতক আসামি সালাউদ্দিন সালেহীনও ছিলেন। যদিও এরা প্রত্যেকেই পরবর্তীতে ছাড়া পান। পরে আবারও গ্রেফতার হন। প্রথম চারজনের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়। ঘটনাটি সে সময় দেশ-বিদেশে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করলেও কয়েকদিনের মধ্যে প্রেক্ষাপট বদলে যায়। প্রথমে অস্ত্র হারানোর অপরাধে দুই কনস্টেবলকে চাকরিচ্যুত করা হয়। কিন্তু বিশেষ জেলার লোক হওয়ায় কিছুদিনের মধ্যেই তারা চাকরি ফিরে পান। অন্যদিকে ওসি ইকবাল শফির ওয়াকিটকি হারানোর অপরাধে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হলেও তা থেকে তিনি খালাস পান। অথচ সব কৃতিত্ব এসআই শফিকুলের, তদুপরি অদৃশ্য শক্তির রোষানলে পড়তে হয় তাকে। কয়েকদিনের মধ্যে তার পঞ্চগড়, খাগড়াছড়ি ও ডিএমপিতে একই সঙ্গে বদলির আদেশ হয়, যা নিয়মনীতি পরিপন্থী।

এসআই শফিকুল ডিএমপিতে যোগদান করলে জয়পুরহাট জেলার পুলিশ সুপার এসআই শফিকুলকে ওই ঘটনায় বিভাগীয় মামলার দণ্ডস্বরূপ ‘ব্ল্যাক মার্ক’ প্রদান করে ডিএমপিতে পাঠান। যার ফলে ডিএমপির ঊর্ধ্বতন পুলিশের কাছে এসআই শফিকুল চোখের বালি হয়ে যান। এসআই শফিকুল মিরপুর থানায় কর্মরত থাকাকালে ওই থানায় ওসি ছিলেন ইন্তেজার রহমান। যিনি ঢাকাস্থ বগুড়া সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ২০০৪ সালে ইন্তেজার রহমান ছিলেন একজন ক্ষমতাধর ওসি। নানাভাবে তাকে সমস্যায় ফেলার চেষ্টা করা হয়। অবশেষে একটি ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে তাকে অভিযুক্ত করা হয়। একই ঘটনায় ওসি ও আরেক এসআই অভিযুক্ত হলেও তারা ছাড় পেয়ে যান। ওই ঘটনায় এসআই শফিকুলের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা নম্বর-৫৩/২০০৫, তাং-১০/০৩/২০০৫ (পিআরবি মূলে) রুজু করান। ডিসি কোহিনুর মিয়া এসআই শফিকুলকে পিআরবি আইনে বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট কর্তনের দণ্ড প্রদান করেন। এসআই শফিকুল বলেন, জেএমবি গ্রেফতার করায় কোনো স্বার্থান্বেষী মহলের সুনাম নষ্ট হওয়ার ষড়যন্ত্রস্বরূপ তার বিরুদ্ধে এসব সাজানো বিভাগীয় মামলার দণ্ড তার ভবিষ্যৎ চাকরিজীবনে পদোন্নতির অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে, তাই তিনি ডিএমপি পুলিশ কমিশনার বরাবর আপিল করেন। ডিএমপি হেডকোয়ার্টারে যার মাধ্যমে আপিল করতে হয় তিনি ছিলেন আর আই ইউনুস আলী, তিনিও ছিলেন বগুড়ার লোক এবং ওসি ইন্তেজারের পরম বন্ধু। ফলে আপিলে তার সাজা মওকুফ না করে বরং তাকে চাকরি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, জয়পুরহাট জেলার মামলার বিচারক মন্তব্য করেছেন, ‘এই মামলাটি যদি পুলিশ সঠিকভাবে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিত তাহলে হয়তো বাংলাদেশে জেএমবি বিস্তার লাভ করত না’ অথচ সেই সাহসী পুলিশ অফিসার এসআই শফিকুল ইসলাম পুরস্কৃত না হয়ে বরং কোনো প্রকার অপরাধ না করেও শুধু ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে চাকরিচ্যুত হয়েছেন।

সর্বশেষ খবর