বুধবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা
নদী বাঁচাও ৪

ধুঁকছে ব্রহ্মপুত্র সংকটে অর্ধশত নদী

সৈয়দ নোমান, ময়মনসিংহ

ধুঁকছে ব্রহ্মপুত্র সংকটে অর্ধশত নদী

খাঁ খাঁ করছে ব্রহ্মপুত্র। এ নদ এখন ধু ধু বালুকাময় পায়ে চলার পথ। মরুভূমি হয়ে ওঠা এ নদে ক্রমাগত পলি জমে ভরাট হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে ব্রহ্মপুত্র-যমুনার সংযোগ মুখ। এ কারণে বৃহত্তর ময়মনসিংহের ছয় জেলার নদীনির্ভরশীল প্রায় আড়াই কোটি মানুষ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। মাইলের পর মাইল জেগে ওঠা চরে মানুষ চাষাবাদ করছে হরেক রকমের ফসল।

শুধু পলি জমাই নয়, ব্রহ্মপুত্রের বুক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বালুসন্ত্রাসীরা। শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া এই নদের ১৫ কিমির মধ্যে কমপক্ষে ১৫টি স্পটে অবৈধ বালুঘাট রয়েছে। এসব বালুঘাট থেকে প্রতিদিন দেদারসে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। প্রশাসনের নাকের ডগায় স্রোতহীন ব্রহ্মপুত্র বালুসন্ত্রাসীদের দ্বারা প্রতিমুহূর্তে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে। শুধু ব্রহ্মপুত্রই নয়, অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে ময়মনসিংহের অর্ধশত নদ, নদী, উপনদী, শাখানদী। ইতিমধ্যে দৃশ্যপট থেকে বিলীন হয়ে গেছে অনেক নদী। খাল হয়ে মরা লাশের মতো পড়ে আছে কোনো কোনোটি। অধিকাংশ নদীই নানা সংকটে মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে অন্তিম যাত্রার প্রহর গুনছে। ময়মনসিংহ জেলার ১৩ উপজেলার ৪৭টি নদী, উপনদী বা শাখানদীর উজ্জ্বল অতীত থাকলেও বর্তমান অবস্থা বড়ই করুণ। এগুলোর ভবিষ্যৎ আরও শঙ্কার। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে জানা গেছে, ময়মনসিংহের প্রধান নদ পুরনো ব্রহ্মপুত্র। এই ব্রহ্মপুত্র নদ ঘিরেই ময়মনসিংহ শহরের গোড়াপত্তন। একদা এ নদের বুকে উত্তাল তরঙ্গ খেলত। বুক চিরে তরতর করে বয়ে যেত পালতোলা নৌকা, সওদাগরের বজরা। বাংলাদেশের নদীমালার মধ্যে দৈর্ঘ্যে সর্ববৃহৎ এবং বিশ্বের ২২তম দীর্ঘ (২ হাজার ৮৫০ কিমি) এই ব্রহ্মপুত্র নদের অবস্থা এখন খুবই রুগ্্ণ। ভরা মৌসুমেও থাকে না যৌবন। শুষ্ক মৌসুমে ধু ধু বালুকাময় চর জেগে ওঠে স্থানে স্থানে। নাব্যতা হারিয়ে চরম সংকটে এখন নদটি।

প্রধান এ নদের পাশাপাশি ময়মনসিংহের ভূমি চিরে বয়ে চলা ঝিনাই, আয়মন, সুতিয়া, বানার, খিরু, ঠাডাকুড়া, ঘরোটা, সীমাহালি, নরসুন্দা, বোখাই, নিতারী, সোমেশ্বরী, কংশ, গুনাই, কাঁচামাটিয়া, পানকুরা, সাইদুল, মগরা, রাংরা, খারমোরী, মহাদেব, যদুকাটা, ধনু, বোয়ালাই, শিরখালি, সিংড়া, চেল্লাখালি, মতিচিক, চালহি, বংশাই, মানস, পুতিয়া, জিনজিরাম, সুবনফিরি, বলেশ্বর, ভোগাই কংসা, কউলাই, সিলাই, খারমেনি, সাতারখালি, তারাটিয়া, ঘাগটিয়া, ঝগড়াখালী, নবগঙ্গা, মরা নেতাই, বেনিপোড়া, রূপালী, রাঙ্গানিয়া, মেকিয়ারকান্দা, মালিঝি, খড়িয়া, বালুয়া, আনই, আখিল, বাইজানাসহ প্রায় অর্ধশত নদ-নদীর অবস্থা খুবই করুণ।

স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, একসময় ব্রহ্মপুত্র নদের প্রশস্ততা ছিল ১২ থেকে ১৪ কিলোমিটার। আজ তা ভরাট হতে হতে স্থানভেদে ১০০ থেকে ২০০ মিটারে ঠেকেছে। নদের নেই সেই নাব্যতা। খরস্র্র্র্রোতা এ নদ আজ মরা খালের পরিণতির পথে। ভারত সীমান্তবর্তী হালুয়াঘাট-ধোবাউড়ায় কংস, নেতাই, ক্ষীরু, মেনান, শাওয়াল নদ-নদীগুলো পাহাড়ি ঢলের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এখন পাহাড়ি ঢল নামলেও পলি জমার কারণে পানি নেই। এ ছাড়া সুতিয়া, শীলা, বানার, নরসুন্দা, কাঁচামাটিয়া নদ-নদীর পানি নির্ভরশীল ব্রহ্মপুত্রের ওপর। ব্রহ্মপুত্রের খনন নেই বলে ওই নদ-নদীগুলোও সরু খালে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন উপজেলায় নানা প্রকল্পের মাধ্যমে ছোট নদীগুলো খনন করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও কাগজে-কলমেই তা সীমাবদ্ধ। জানা যায়, ব্রহ্মপুত্র ছাড়াও কংশ ও নেতাইকে নদ হিসেবে অভিহিত করা হয়। কংশ নদের অবস্থা ভরা বর্ষায় থৈ থৈ করলেও বাকি সময়টুকু সকরুণ জীর্ণ অবস্থা। বিস্তীর্ণ চরে তখন চোখে পড়ে নানা ফসলের সমাহার।

ধোবাউড়া উপজেলার সাঁতারখালী, তারাটিয়া, ঘাগটিয়া, ঝগড়াখালী, নবগঙ্গা, মরা নেতাই, বেনিপোড়া, রূপালী, রাঙ্গানিয়া, মেকিয়ারকান্দা, নদীগুলো এখন ইতিহাস। চলছে দখল, হচ্ছে চাষাবাদ। হালুয়াঘাট উপজেলার পাহাড়ি নদী সূর্যপুরডালা। গারো পাহাড়ের পাদদেশ বেয়ে ঝরনার জলরাশি পাহাড়ি ঢল হয়ে নামত। এখন সারা বছর অচল। এ ছাড়া দর্শা, গাঙ্গিনী, বুড়া ভোগাই, মেলং সেওয়াল, পচনধরা, ভোরাঘাট নদীগুলো শুষ্ক মৌসুমে মৃতপ্রায় হয়ে নিথর থাকে।

জানা যায়, উপকারিতা, নদীর মায়া, সৌন্দর্যসহ নানা দিক বিবেচনায় প্রমত্তা আয়মন নদীর তীরে বজরা ভেড়ান আলেপশাহী পরগনার প্রথম জমিদার। সেখানেই তিনি গড়ে তোলেন মুক্তাগাছা শহর। ছোট শহরের তিন দিকে এই নদীর চলন পথ। কিন্তু সেই আয়মন নদী ক্রমেই খাল হয়ে এখন স্মৃতির পথে হাঁটছে। এখানকার শাখানদী ঠাডাকুড়ার অবস্থা আরও করুণ। অন্যতম নদী বানার কিংবা সুতিয়া ভরা বর্ষায় সামান্য নড়াচড়া করলেও শুষ্ক মৌসুমে পড়ে থাকে লাশ হয়ে।

তারাকান্দার ছোট নদী রাংসা। এখন এ নদীর প্রবাহপথ পাওয়াই মুশকিল। মালিঝি নদীরও নেই অস্তিত্ব। খড়িয়া নদীতে খরা আর জলাবদ্ধতাই শেষ কথা। গৌরীপুর উপজেলার বালুয়া নদী সম্পর্কে এখন অনেকেই জানেন না। কালো মাটির জন্য বিখ্যাত নদী কাঁচামাটিয়া। নদীটি ঈশ্বরগঞ্জ-নান্দাইলের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। খনিজ সম্ভাবনাপূর্ণ এ নদী বর্ষা ছাড়া অন্যান্য মৌসুমে ফসলি ক্ষেত। ফুলবাড়িয়া উপজেলা সদরের আখিল, বানার, আনই নদীগুলো শুধু ইতিহাসের পাতায়। ত্রিশালের সুতিয়া, শিলা ও খিরু দক্ষিণ ময়মনসিংহের বড় নদী। এখন এগুলো ছোট খাল। ভালুকার সুতিয়া, খিরু ও শিমুলিয়ার একাত্তরের যুদ্ধস্মৃতিসহ রয়েছে নানা কিংবদন্তি। তবে ময়মনসিংহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জহুরুল ইসলাম জানান, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) একটি প্যাকেজের দরপত্র আগামী সপ্তাহে আহ্বান করেছে। সবকিছু ঠিক থাকলে এর কার্যক্রম শুরু হবে চলতি বছরের মার্চে। তিনি জানান, দরপত্র আহ্বানের পর ২৮ দিনের মধ্যেই জামালপুরের বাহাদুরাবাদ ঘাট থেকে বেলাবু পর্যন্ত ২২৯ কিলোমিটার দীর্ঘ পুরনো ব্রহ্মপুত্র খননের কাজ শুরু হবে। ছয় বছর মেয়াদে এই প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করতে মোট ২৮টি প্যাকেজে আহ্বান করা হবে দরপত্র।

তবে অন্যান্য নদ-নদীর বিষয়ে জহুরুল ইসলাম বলেন, পর্যায়ক্রমে সব নদ-নদী খনন করা হবে। দখল হয়ে থাকলেও উদ্ধার করা হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর