বৃহস্পতিবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

মামলার নিষ্পত্তি দেখা হয় না অনেক বিচারপ্রার্থীর

আরাফাত মুন্না

মামলার নিষ্পত্তি দেখা হয় না অনেক বিচারপ্রার্থীর

মেহেরপুরে একটি জমির মালিকানা নিয়ে মামলা হয় ১৯৬২ সালে। মেহেরপুরের বানিয়াপুকুরের বাসিন্দা ফাকের আলী বিশ্বাস মামলাটির প্রথম বাদী। সেই সময়ে কুষ্টিয়া জেলার একটি আদালতে মামলা হলেও পরবর্তীতে জেলা ঘোষণার পর মামলাটি মেহেরপুর জেলা জজ আদালতে বিচারের জন্য পাঠানো হয়। বাদীর মৃত্যুর পর তার ছেলে স্কুল শিক্ষক নেফাজ উদ্দিন আহমেদ মামলাটি পরিচালনা করে আসছিলেন। প্রায় ১৬ বছর আগে নেফাজ উদ্দিনও মারা গেছেন। বর্তমানে মামলা পরিচালনার দায়িত্ব পড়েছে নেফাজ উদ্দিনের ছেলে সরকারি কর্মকর্তা রাজু আহমেদের ওপর। দুই পুরুষ কবরবাসী হয়েছে, কিন্তু মামলাটি এখনো হাই কোর্টে ঘুরপাক খাচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২২ বিঘা সম্পত্তি নিয়ে দায়ের করা এ মামলার বিচার শেষ হতে জেলা জজ আদালতেই কেটে গেছে প্রায় ৪২ থেকে ৪৩ বছর। জজ কোর্ট পর্যন্ত মামলার বাদীপক্ষ জয়লাভ করে। এরপর ২০০৪ সালে বিবাদীপক্ষ হাই কোর্টে সিভিল রিভিশন (মামলা নম্বর-৩০৫৮/২০০৪; মোসাৎ কবিতা বনাম রাজু আহমেদ) দায়ের করে। দায়েরের প্রায় ১০ বছর পর ২০১৪ সালের মে মাসে সিভিল রিভিশনটি নিষ্পত্তি করে হাই কোর্ট মামলাটি আবারও নিম্ন আদালতে রিমান্ডে পাঠায়। মূল মামলার বাদী রাজু আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, মামলাটি তামাদি আইনের দোষে দুষ্ট কিনা এবং সহ-অংশীদার দাবি করে যে মামলা করা হয়েছে সেটা ঠিক আছে কিনা সে বিষয়টি পরিষ্কার করতে পুনরায় শুনানির জন্য হাই কোর্ট মামলাটি রিমান্ডে পাঠায়। মেহেরপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালত এ বিষয়ে শুনানি করে গত বছরের ২০ জুলাই নিষ্পত্তি করে রায় দেয়। রায় আমরা পক্ষে পেয়েছি। কিন্তু বিবাদীপক্ষ দ্বিতীয় দফায় হাই কোর্টে রিভিশন আবেদন করেছে। আমি ৯ বছর ঘুরে শুনানির জন্য মামলাটি হাই কোর্টের কার্যতালিকায় ওঠাতে পেরেছিলাম। জানি না এবার কার্যতালিকায় ওঠাতে কত বছর লাগে। শুধু ভাবী আমি বেঁচে থাকতে হয়তো মামলাটির নিষ্পত্তি হবে না। অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু রাজু আহমেদের এই মামলাটি নয়, দেশের আদালতগুলোতে ৩০ থেকে ৩৫ বছরের পুরনো দেওয়ানি মামলার উদাহরণ পাওয়া যাবে অনেক। ১৯৬১ ও ১৯৬২ সালের আরও দেওয়ানি মামলা এখনো ঢাকার আদালতেই বিচারাধীন আছে। জমি-সংক্রান্ত এসব দেওয়ানি মামলা বংশপরম্পরায় চলছে। এরপর আবার বছর গড়ালেই বাড়ছে বিচারাধীন মামলা। বর্তমানে সারা দেশে বিচারাধীন দেওয়ানি মামলার সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ ২৯ হাজার ৮৬১টি। এর মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ১৩ হাজার ১৯৯টি এবং হাই কোর্টে ৯৫ হাজার ৬২৪টি দেওয়ানি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। বাকি ১৩ লাখ ২১ হাজার ৩৮টি মামলাই বিচারাধীন রয়েছে সারা দেশের অধস্তন আদালতগুলোতে। মামলার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতিনিয়ত উচ্চ আদালত থেকে নি¤œ আদালত পর্যন্ত বিচারাধীন সব ধরনের মামলার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আর মামলার সংখ্যা যতই বাড়ছে, ততই বাড়ছে বিচার প্রার্থীদের দুর্ভোগও। তবে দেওয়ানি মামলায় দুর্ভোগ সবচেয়ে বেশি। সরকার দুর্ভোগ কমাতে দেওয়ানি কার্যবিধি সংশোধন করে এডিআর (বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি) ব্যবস্থা চালু করেছে। আগের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে বিচারকের সংখ্যা। কিন্তু কোনো উদ্যোগই কাজে আসছে না। দেওয়ানি মামলার বিচারে দীর্ঘসূত্রতা যেন এখন একটি সিস্টেমে (পদ্ধতিতে) পরিণত হয়েছে।

দেওয়ানি মামলার বিচার বিলম্বের বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মামলা বাড়ছে। আগের চেয়ে এখন মানুষ বেশি আদালতমুখী। মানুষ সামান্য বিষয় নিয়েই মামলা করছে। মামলার বিচার চলাকালে করণে-অকারণে বার বার মুলতবি করার আবেদন করা হয়। এসব কারণে মূলত যুগের পর যুগ বিচার চলতেই থাকছে। এভাবে চলতে থাকলে বিচার বিভাগের প্রতি বিচার প্রার্থীদের আগ্রহ কমে যাবে। তিনি আরও বলেন, আমি মন্ত্রী থাকাকালে দেওয়ানি কার্যবিধি সংশোধন করে এডিআর চালু করেছি। দুর্ভোগ থেকে রেহাই পেতে এখন মানুষের এডিআরমুখী হওয়া উচিত। এতে আইনজীবীদেরও আগ্রহ দেখাতে হবে।

জানতে চাইলে আইনজীবী ইমতিয়াজ আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশে মিথ্যা মামলার জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা চালু রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে সেটি নেই। মিথ্যা মামলার ক্ষেত্রে মামলায় হেরে গেলে মামলার যাবতীয় খরচ মামলাকারীকে বহন করার বিধান চালু করলে মামলার সংখ্যা অনেকটা কমে আসবে। এতে দুর্ভোগও কমবে বলে আমি মনে করি। এ ছাড়া আমাদের দেশে বিচারক অনেক কম। মামলার জট কমাতে বিচারকের সংখ্যা বাড়াতে হবে।

 

সর্বশেষ খবর