শুক্রবার, ১৭ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

বদলে যাচ্ছে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল

রাহাত খান, বরিশাল

বদলে যাচ্ছে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল

দীর্ঘদিন পর কেউ পদ্মার পশ্চিমপাড় এলে বিস্মিত হবেন। নিজেকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে, এটি কি সত্যিই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল! শুধু উন্নয়ন আর উন্নয়নযজ্ঞ। আর এসব কিছুর মূলে দেশের তৃতীয় ও নির্মাণাধীন পায়রা সমুদ্রবন্দর। এক বন্দরকে কেন্দ্র করে নিজস্ব অর্থে নির্মাণ হচ্ছে পদ্মা সেতু। এই পদ্মা আর পায়রাকে কেন্দ্র করে পাল্টে যাচ্ছে দেশের দক্ষিণাঞ্চল। বেড়েছে মানুষের কর্মসংস্থান। নতুন শিল্পকারখানায় আগ্রহী হচ্ছেন অনেকে। এ কারণে ১০ গুণ বেড়েছে জমির দাম। রাস্তাঘাটসহ অবকাঠামো সুবিধাও বাড়ছে পর্যায়ক্রমে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় দীর্ঘমেয়াদি ‘সোনালি স্বপ্নে’ বিভোর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ। পদ্মা সেতু প্রকল্প সংশোধন করে ২০১১ সালে আওয়ামী লীগের টানা তৃতীয়বারের প্রথম মেয়াদে রেললাইন যুক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৩ সালের ১৯ নভেম্বর পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় পায়রা সমুদ্রবন্দরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের আগেই পদ্মা সেতু প্রকল্পে রেললাইনসহ গ্যাস, বৈদ্যুতিক লাইন ও ফাইবার অপটিক ক্যাবল যুক্ত  করেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ৩০ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্পের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে সারা দেশের পরিবহন নেটওয়ার্ক ও আঞ্চলিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের শুরু। উইকিপিডিয়ার তথ্য বলছে, পদ্মা সেতু নির্মাণ হলে উপকৃত হবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৭ হাজার বর্গমাইল বা বাংলাদেশের ৩ কোটিরও বেশি মানুষ। বিস্ময়ের শুরু পদ্মা থেকেই। ভাঙ্গা থেকে পায়রা বন্দর পর্যন্ত ফোর লেনের জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া প্রায় সম্পন্ন। রেললাইনের সমীক্ষাও শেষের পথে। ভাঙ্গা থেকে বরিশাল হয়ে পায়রা সমুদ্রবন্দর যেতে গৌরনদীর সাউদের খাল, গায়নাঘাটা, আশোকাঠি, রহমতপুর ও বাকেরগঞ্জের বোয়ালিয়া এবং বাকেরগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে চোখে পড়বে ৬ সেতু নির্মাণের কাজ। ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের রহমতপুরে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ হচ্ছে বিমানবাহিনীর রাডার স্টেশন। লেবুখালীতে পায়রা নদীর ওপর নির্মাণ হচ্ছে ফোর লেন পায়রা সেতু। ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘এক্সট্রা ডোজ ক্যাবল স্ট্রেট’ পদ্ধতির সেতুটি পর্যটনের কথা বিবেচনায় নিয়ে নির্মাণ হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সেতু প্রকল্পের সাবেক আবাসিক প্রকৌশলী মনজিৎ কুমার সাহা। সেতু পয়েন্টেই গত বছর প্রায় আড়াই হাজার একর জমির ওপর ‘শেখ হাসিনা সেনানিবাস’-এর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। লেবুখালীর পায়রা নদীর পাড় হয়ে পায়রা বন্দরের দিকে যেতে মহাসড়কের দুই পাশে চোখে পড়বে বিভিন্ন কোম্পানি, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, গার্মেন্ট ও বিভিন্ন হাউজিং প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড। পটুয়াখালী-কলাপাড়া মহাসড়কের রজপাড়া (বারকানী) থেকে পূর্বে বন্দরের দিকে ৩০৬ কোটি টাকা ব্যয়ে এক ফুট উঁচু (পুরু) ও ৩৩ ফুট প্রশস্ত ৫.২২ কিলোমিটার দীর্ঘ শেখ হাসিনা ফোর লেন সড়ক নির্মাণের ব্যাপক কর্মযজ্ঞ দেখলে আগামীর পায়রা বন্দরের একটি ধারণা পাবেন। পায়রা বন্দর হবে আধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানের। টিয়াখালীতে ১৬ একর জমির ওপর ব্যাকআপ ফেসিলিটিজ এরিয়া ও ৩২ একর জমিতে কোয়ার্টার নির্মাণের কাজ চলছে।

এ ছাড়া জলযান পাইলট ভেসেল, হেভি ডিউটি স্পিডবোট, টাগবোট, বয়া লেইং ভেসেল এবং জরিপ বোট নির্মাণের কাজও শেষ পর্যায়ে। ভূমি অধিগ্রহণের কারণে বাস্তুহারা ৩ হাজার ৫০০ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পুনর্বাসনের জন্য আনুষঙ্গিক সুবিধাসহ ১ হাজার ৫৯ কোটি টাকা ব্যয়ে লালুয়া, উত্তর চান্দুপাড়া, দক্ষিণ চান্দুপাড়া, লেমুপাড়া, ধুলাসার ও লোন্দা এলাকায় পৃথক ৬টি আবাসন নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলছে। পাবলিক-প্রাইভেট চুক্তিতে (পিপিপি পদ্ধতিতে) পায়রা বন্দরের ৪টি প্রকল্প ড্রাই বাল্ক/কোল টার্মিনাল, ক্যাপিটাল অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স ড্রেজিং, জিওবি টার্মিনাল এবং ভারতীয় ঋণ সহায়তায় মাল্টিপারপাস টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পায়রা বন্দর থেকে খালাসকৃত পণ্য অন্যত্র পরিবহনের লক্ষ্যে রাবনাবাদ চ্যানেলসংলগ্ন এলাকায় অবকাঠামো সংযোগ সড়ক, আন্ধারমানিক নদের ওপর সেতু ও ৬৫০ মিটার দৈর্ঘ্যরে জেটিসহ একটি টার্মিনাল নির্মাণের জন্য ৩ হাজার ৯৮২ কোটি টাকা ব্যয়প্রস্তাব-সংবলিত পায়রা বন্দরের জিওবি টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পটি ৪ নভেম্বর একনেকের সভায় অনুমোদিত হয়।

রাবনাবাদ চ্যানেলের চার্ট গভীরতা ১০.৫ মিটারে উন্নীত করতে পায়রা বন্দরের মূল চ্যানেলে ‘ক্যাপিটাল অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স ড্রেজিং’ প্রকল্পটি গত বছর ১৯ মার্চ মন্ত্রিসভায় জাতীয় অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অগ্রাধিকারভিত্তিক এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য বেলজিয়ামভিত্তিক আন্তর্জাতিক ড্রেজিং কোম্পানি ‘জান ডে নুল’-এর সঙ্গে ১৪ জানুয়ারি পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের চুক্তি হয়েছে।

সাড়ে ৬ হাজার একর জমির ওপর পূর্ণাঙ্গ পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ডিটেইল্ড মাস্টারপ্ল্যান অনুসরণ করে আরও ৪টি টার্মিনাল বন্দর কর্তৃপক্ষ পিপিপি ও জি টু জি পদ্ধতিতে ২০২৫ সালের মধ্যে নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে। বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে কলাপাড়ায় নির্মাণ হচ্ছে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন পৃথক ৪টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটার উন্নয়নেও মেরিন ড্রাইভ নির্মাণসহ মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নে কুয়াকাটার লতাচাপলী মৌজার ১০ হাজার ২৭৯ একর জমি সংরক্ষিত জোনের আওতায় নেওয়া হয়েছে। কুয়াকাটায় একটি আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেট স্টেডিয়াম, একটি বিশ্ববিদ্যালয়, প্লে-গ্রাউন্ড, কনভেনশন সেন্টার, ওয়াচ টাওয়ার, আধুনিক হাসপাতাল, সুপার মার্কেট, সরকারি-আধাসরকারি সব অফিস, মিউজিয়াম, ফায়ার সার্ভিস স্টেশন, শহীদ মিনার, হেলিপ্যাড, হিস্টরিক সাইট, বাস-টার্মিনাল, লঞ্চঘাট, বিশেষ মার্কেট, ইকো পার্ক, মৎস্য মার্কেট, মেরিন পার্ক, মেরিন ড্রাইভ, টেনিস পার্ক এবং সাবজেল নির্মাণ করা হবে। হিজলা উপজেলার চরমেঘায় দেশের দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই চলছে। বরিশাল-ভোলা সড়ক যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে তেঁতুলিয়া ও কালাবদর নদে সেতু নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ হয়েছে। ভোলার গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে বরিশালে সরবরাহের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। গ্যাস সরবরাহ পেলে বরিশালের শিল্পকারখানা অন্যান্য শিল্প এলাকার মতো সমানতালে চলতে পারবে বলে মন্তব্য করেন বরিশাল চেম্বারের সভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু। বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মন্ত্রী পদমর্যাদার (পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন নিরীক্ষা কমিটির আহ্বায়ক) আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এমপি বলেন, ‘না চাইতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলবাসীর জন্য সবকিছু দিয়েছেন। এ অঞ্চলের মানুষ আজীবন প্রধানমন্ত্রীর অবদান মনে রাখবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর