কাগজে-কলমে বিশ্বের ১৬৮টি দেশে কাজের উদ্দেশ্যে জনশক্তি রপ্তানির তথ্য থাকলেও মূলত মধ্যপ্রাচ্যই বাংলাদেশি কর্মীদের প্রধান লক্ষ্য। আর রেমিট্যান্স আয়ের বড় অংশটি আসে সেই অঞ্চল থেকেই। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সম্ভাবনাময় মধ্যপ্রাচ্য এখন সংকটের দিকে যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়েছে জনশক্তি রপ্তানিতে। ওই অঞ্চল থেকে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স আয়ের হার কমে যাচ্ছে। জনশক্তি রপ্তানিতেও পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। অর্থ মন্ত্রণালয় প্রণীত অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৯ বলছে, মোট রেমিট্যান্স আয়ের একক দেশ হিসেবে সৌদি আরব এখনো শীর্ষে অবস্থান করলেও গত এক দশকে এ হার উল্লেখ্যযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। ১০ বছর আগে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট রেমিট্যান্সের ৩০ শতাংশ এসেছে সৌদি আরব থেকে, গত অর্থবছরে তা কমে ১৭ শতাংশে নেমে আসে। এক দশক আগে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ১৮ শতাংশ রেমিট্যান্স এলেও গত অর্থবছরে তা কমে ১৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। একইভাবে রেমিট্যান্স হার কমেছে কুয়েত থেকেও। সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, শুধু যে রেমিট্যান্স আয়ের হার কমছে তাই নয়, মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ২০১৭ সালে সৌদি আরবে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৫ লাখ ৫১ হাজার কর্মী গিয়েছিল কাজের জন্য, ২০১৮ সালে ওই দেশে জনশক্তি রপ্তানি প্রায় অর্ধেক কমে ২ লাখ ৫৭ হাজার নেমে আসে। সংযুক্ত আরব আমিরাতে জনশক্তি রপ্তানিতে ধস নেমেছে গত ৬ বছর ধরেই। ২০১২ সালেও দেশটিতে ২ লাখের উপরে জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ থেকে দেশটিতে মাত্র ১ হাজার ৭৮৬ জন কর্মী গেছে কাজের উদ্দেশ্যে। আগের বছর গিয়েছিল ৪ হাজার ১৩৫ জন। মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ কাতারে ২০১৭ সালে জনশক্তি রপ্তানি হয়েছিল ৮২ হাজার জন প্রায়। গত বছর তা কমে ৭৬ হাজার ৫শতে দাঁড়িয়েছে। ওমানে ২০১৭ সালে ৮৯ হাজার শ্রমশক্তি রপ্তানি হলেও ২০১৮ সালে সেই সংখ্যাটি ৭২ হাজার ৫শতে নেমে এসেছে। কুয়েতে ২০১৭ সালে শ্রম রপ্তানির পরিমাণ ছিল প্রায় ৫০ হাজার জন, যেটি গত বছর প্রায় ২৭ হাজারে নেমে এসেছে। জর্ডানে ২০১৭ সালে ২০ হাজার ৪শ জন কর্মী বাংলাদেশ থেকে গিয়েছিল কাজের জন্য, সেটি ২০১৮ সালে কমে ৯ হাজার ৭২৪ জনে নেমে এসেছে। বাহরাইনে ২০১৭ সালে প্রায় ৭২ হাজার কর্মী গিয়েছিল, গত বছর তা কমে ১৯ হাজারে দাঁড়িয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি রপ্তানির এই নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সামগ্রিকভাবে পরিসংখ্যানেও। ২০১৭ সালে বিদেশে কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে ১০ লাখ ৮ হাজার ৫২৫ জন কর্মী গিয়েছিল বাংলাদেশ থেকে। ২০১৮ সালে ৭ লাখ ৩৪ হাজার ১৮১ জন কর্মী রপ্তানি হয়েছে। সংখ্যাটি আগের বছরের চেয়ে প্রায় ২ লাখ ৭৪ হাজার ৩৪৪ জন কম।
শ্রম রপ্তানির এই নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে অর্থনৈতিক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্য বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বিশাল শ্রমবাজার। বর্তমানে এ অঞ্চলে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও শ্রমিকের চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় প্রচলিত শ্রমবাজার ছাড়াও নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ধানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্স ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা ছাড়া সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে- মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতি ও অভ্যন্তরীণ চাহিদা তেলের দামের সঙ্গে সম্পর্কিত। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, নীতিগত জায়গায় তারা বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছে। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে নিজস্ব শ্রমিকদের অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয়ের হারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এটি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নতুন নতুন দেশে শ্রম রপ্তানির সুযোগ তৈরি করতে হবে। এ ছাড়া স্বল্প দক্ষ থেকে দক্ষ শ্রম রপ্তানিতে জোর দিতে হবে। বিশেষ কওে যেসব দেশে জনশক্তি রপ্তানি করা হবে, সে দেশের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এ ছাড়া স্বল্প খরচে দেশে রেমিট্যান্স আনার উদ্যোগ নিতে হবে।