বুধবার, ২৬ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

ঢাবির ফার্মেসি অনুষদের পরীক্ষায় দুধের সাত ব্র্যান্ডে ক্ষতিকর উপাদান

বিএসটিআইয়ের দাবি আশঙ্কাজনক কিছু নেই

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক

বাজারে বিক্রি হওয়া ১৪টি ব্র্যান্ডের পাস্তুরিত তরল দুধের ১৮টি নমুনা পরীক্ষা করে আশঙ্কাজনক কোনো কিছু নেই। গতকাল হাই কোর্টে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে এমন তথ্য জানিয়েছে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদ এবং বায়োমেডিকেল রিসার্চ সেন্টারের নমুনা পরীক্ষায় পাওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাজারে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া প্রাণ, মিল্কভিটা, আড়ংসহ নামি-দামি ব্র্যান্ডের পাস্তুরিত সাতটি দুধ-ই মানহীন। এগুলোর কোনোটিতে মিলেছে মাত্রাতিরিক্ত কলিফর্মের উপস্থিতি, আবার কোনোটিতে মিলেছে অ্যান্টিবায়োটিক। এই তালিকায় আরও আছে বাজারে সর্বোচ্চ বিক্রিত ঘি, ফ্রুট ড্রিংক, গুঁড়া মসলা, ভোজ্য তেলসহ অন্তত ৮ রকমের পণ্য। যেগুলোর প্রতিটিতে রয়েছে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক উপাদান। ফার্মেসি অনুষদের কয়েকজন শিক্ষক সম্প্রতি বাজারে বেশি বিক্রি হওয়া কিছু খাদ্যপণ্যের নমুনা সংগ্রহ করে সেগুলোর গুণগত মান পরীক্ষা করেন। গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনের ওই পরীক্ষার ফলাফল তুলে ধরা হয়। এতে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বায়োমেডিকেল রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক আ ব ম ফারুক। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, পাস্তুরিত দুধের সাতটি নমুনার কোনোটিতেই কাক্সিক্ষতমাত্রার ‘সলিড নট ফ্যাট’ পাওয়া যায়নি। এই সাতটি নমুনার মধ্যে ছিল- মিল্ক ভিটা, আড়ং, প্রাণ, ফার্ম ফ্রেস, ঈগলু, ঈগলু চকোলেট এবং ঈগলু ম্যাংগো। বিএসটিআই স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী দুধে ‘ফ্যাট ইন মিল্ক’ ৩.৫ শতাংশ থাকার কথা থাকলেও তা আছে ৩.৬ শতাংশ থেকে ৩.৬১ শতাংশ পর্যন্ত।

অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, সবচেয়ে উদ্বেগের হলো দুধে অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি। পাস্তরিত দুধের সাতটি নমুনার প্রায় সবগুলোতে মানব চিকিৎসায় ব্যবহৃত লেভোফ্লক্সাসিন, এজিথ্রোমাইসিন এবং সিপ্রোফ্লক্সাসিন ইত্যাদি অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও সবগুলো নমুনায় ফরমালিন এবং তিনটি নমুনায় ডিটারজেন্টের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। মান পরীক্ষা করতে গিয়ে তারা ফ্রুট ড্রিংকসের ১১টি নমুনার সবগুলোতে নিষিদ্ধ ক্ষতিকর সাইক্লামেট পেয়েছেন। নমুনাগুলো হলো- স্টার শিপ ম্যাংগো ফ্রুট ড্রিংকস, সেজান ম্যাংগো ড্রিংক, প্রাণ ফ্রুটো, অরেনজি, প্রাণ জুনিয়র ম্যাংগো ফ্রুট ড্রিংক, রিটল ফ্রুটিকা, সান ড্রপ, চাবা রেড এপল, সানভাইটাল নেক্টার ডি ম্যাংগো, লোটে সুইটেন্ড এপলন ড্রিংক, ট্রপিকানা টুইস্টার প্রভৃতি। এর মধ্যে তিনটিতে ছিল নিষিদ্ধ কলিফর্ম কাউন্টের উপস্থিতি এবং সাতটিতে মাত্রাতিরিক্ত টোটাল প্লেট কাউন্ট। এ ছাড়া মান পরীক্ষায় আরকো, বিডি, ড্যানিশ, ফ্রেস, প্রাণ, রাঁধুনি ও প্লাস্টিকের ব্যাগে খোলা বিক্রি হওয়া শুকনা মরিচ ও হলুদের মধ্যে বিএসটিআই স্ট্যান্ডার্ডের অতিরিক্ত জলীয় পদার্থের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। হলুদে ছিল ‘মেটানিল ইয়েলো’ নামের কাপড়ের রং। যা বিশে^র কোথাও গ্রহণযোগ্য নয়। আড়ং, বাঘাবাড়ি, প্রাণ, মিল্ক ভিটা, মিল্কম্যান, সুমির ও টিনে বিক্রি হওয়া ঘি’ও মানোত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রূপচাঁদা, পুষ্টি, সুরেশ, ড্যানিশ ও বসুধা সরিষা তেলসহ বাজারে বিক্রি হওয়া বিভিন্ন ভোজ্যতেলও মানহীন। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, মান পরীক্ষায় মিজান ও টিনে খোলা অবস্থায় বিক্রি হওয়া নামবিহীন ১০টি পাম ওয়েলের নমুনার সবগুলোই মানোত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয়। এ ছাড়া রূপচাঁদা, রাঁধুনি, তীর, ফ্রেশ, পুষ্টি, সুরেশ, ড্যানিশ, এসিআই, মুসকান ইত্যাদি ব্র্যান্ডের সরিষা এবং সয়াবিন তেলের আটটি করে নমুনার মধ্যে সয়াবিন তেলের সাতটি এবং সরিষার তেলের আটটির মধ্যে স্যাপনিফিকেশন ভ্যালু, সয়াবিন তেলের পাঁচটি এবং সরিষার তেলে চারটির মধ্যে পারক্সাইড ভ্যালু, তিনটির মধ্যে রিলেটিভ ভ্যালু মাত্রাতিরিক্ত অবস্থায় ছিল। সব নমুনাতেই ছিল অতিরিক্ত জলীয় পদার্থের উপস্থিতি।অধ্যাপক ফারুক বলেন, ভেজাল খাদ্যের কারণে আর্থিক ও মানসিক ক্ষতি তো হচ্ছেই, সবচেয়ে বড় হলো শারীরিক ক্ষতি। সংবাদ সম্মেলনে ফার্মেসি অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. এস এম আবদুর রহমান, ওষুধ রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. ফিরোজ আহমেদসহ বিভাগের অন্যান্য শিক্ষক ও গবেষকরা উপস্থিত ছিলেন।

হাই কোর্টে বিএসটিআইর প্রতিবেদন : বিএসটিআই গতকাল আদালতে যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, বাজারে বিক্রি হওয়া ১৪ ব্র্যান্ডের ১৮টি পাস্তুরিত তরল দুধের নমুনা পরীক্ষা করে আশঙ্কাজনক কোনো কিছু পাওয়া যায়নি। প্রতিবেদনে যে ১৪টি ব্র্যান্ডের কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো হলো- পুরা, আয়রান, আড়ং ডেইরি, ফার্ম ফ্রেশ মিল্ক, মো, মিল্ক ভিটা, আফতাব, আল্ট্রা, তানিয়া (২০০ গ্রাম ও ৫০০ গ্রাম), ঈগলু, প্রাণ মিল্ক, ডেইরি ফ্রেশ, মিল্ক ফ্রেশ এবং কাউহেড পিওর মিল্ক। গতকাল বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি ইকবাল কবিরের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চে প্রতিবেদনটি দাখিল করা হয়। পরে এ মামলার কার্যক্রম আগামীকাল পর্যন্ত মুলতবি হয়। আদালতে শুনানিতে ছিলেন রিটকারী আইনজীবী তানভীর আহমেদ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কাজী জিনাত হক। বিএসটিআইয়ের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী সরকার এম আর হাসান (মামুন)।

প্রসঙ্গত, গত বছর ১৭ মে ‘পাস্তুরিত দুধের ৭৫ শতাংশই নিরাপদ নয়’ উল্লেখ করে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। পরে প্রতিবেদনগুলো আদালতে নজরে আনা হলে আদালত এ বিষয়ে রিট আবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়। এ নিয়ে গত বছর ২০ মে হাই কোর্টে রিট করেন আইনজীবী তানভির আহমেদ। আদালত এসব ব্র্যান্ডের পাস্তুরিত তরল দুধের মান পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয়ের গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটিকে নির্দেশ দেয়।

সর্বশেষ খবর