রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ী খাল থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গুলি উদ্ধারের ঘটনা সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে। অথচ প্রায় তিন বছর হতে চললেও তার তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই। ২০১৬ সালের ওই ঘটনার পর ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া জানিয়েছিলেন, যারা দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে জড়িত, তারাই অস্ত্রগুলো সেখানে রেখেছে বলে ধারণা করছেন। ওই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে কারা জড়িত, তা উদ্ঘাটনের তেমন কোনো চেষ্টা এরপর আর দেখা যায়নি। অস্ত্রগুলো কোথা থেকে এসেছে এবং কেন আনা হয়েছে- এসব প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তরও তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কাছে মেলেনি। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের গুরুতর সন্দেহের কথা বলা হলেও অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। তুরাগ থানায় সে সময় যে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছিল, তার ভিত্তিতেই তদন্ত শুরু হয়। এ বিষয়ে তুরাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূরুল মোত্তাকিন এ প্রতিবেদককে জানান, অস্ত্রগুলো তখনই উদ্ধার করে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়। এরপর জিডি হয়েছিল, কিন্তু ওই জিডির ভিত্তিতে তদন্তের কোনো অগ্রগতি হয়নি। এ ছাড়া পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটসহ অন্যান্য সংস্থাও ছায়া তদন্ত করে।
পুলিশের করা জিডি থেকে জানা যায়, ২০১৬ সালের ১৮ জুন দিয়াবাড়ী খাল থেকে সাতটি ব্যাগের ভিতর ৯৭টি পিস্তল, ৪৬২টি ম্যাগাজিন, এক হাজার ৬০টি গুলি, ১০টি বেয়নেট, ১৮০টি ক্লিনিং রড এবং ১০৪টি স্প্রিংযুক্ত বাক্স উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার পিস্তলের মধ্যে ৯৫টি ছিল সেভেন পয়েন্ট সিক্স টু বোরের, আর দুটি নাইন বোরের। গুলির মধ্যে ২২০টি সেভেন পয়েন্ট সিক্স টু বোর পিস্তলের এবং ৮৪০টি নাইন এমএম পিস্তলের। ম্যাগাজিনের মধ্যে ২৬৩টি এসএমজির হলেও কোনো সাব মেশিনগান সেখানে পাওয়া যায়নি। বাকি ম্যাগাজিনগুলো ছিল পিস্তলের। পরদিন ওই খাল থেকে আরও তিনটি ব্যাগ উদ্ধার করা হয়। ভিতরে পাওয়া যায় এসএমজির আরও ৩২টি ম্যাগাজিন এবং আটটি ক্লিনিং রড। আর ২৫ জুন তিনটি ব্যাগ থেকে সাত প্যাকেট বিস্ফোরক জেল, পাঁচটি ওয়াকিটকি, দুটি বড় আকারের ট্রান্সমিটার, দুটি ফিডার কেবল, প্লাস্টিকের ২২টি কৌটায় বিভিন্ন ধরনের আইসি, ট্রানজিস্টার, ক্যাপাসিটার ও সার্কিট, ৪০টি পলিথিনের ব্যাগে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম, রুপালি ও সবুজ রঙের ৩২৫টি স্প্রিংযুক্ত বাক্স উদ্ধার করা হয়। তুরাগ থানা পুলিশ জানায়, পরিত্যক্ত অবস্থায় কোনো আগ্নেয়াস্ত্র বা মাদক উদ্ধার হলে প্রথমে জিডি হয়। পরে তদন্তে যদি জানা যায় আগ্নেয়াস্ত্র বা মাদক কোথাও যাচ্ছিল, তখন সেই জিডি মামলায় রূপান্তরিত করা হয়। যেহেতু পরিত্যক্ত অবস্থায় আগ্নেয়াস্ত্রগুলো উদ্ধার করা হয়েছিল তাই জিডি হয়েছে। কারও হেফাজত থেকে বা যদি জানা যেত যে আগ্নেয়াস্ত্রগুলো কারও কাছে যাচ্ছিল তাহলে মামলা হতো।
২০১৬ সালে তিন দফায় উত্তরা ১৬ নম্বর সেক্টরের দিয়াবাড়ী খালে পানির নিচে ১৩টি ট্রাভেল ব্যাগ থেকে পিস্তল, এসএমজির ম্যাগাজিন, গুলি, বেয়নেট, বিস্ফোরক জেল, ওয়াকিটকিসহ বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইস উদ্ধার করে পুলিশ। সারা দেশে একের পর এক জঙ্গি হামলা ও হত্যাকাে র মধ্যে অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারের ওই ঘটনা দেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। তবে তৃতীয় দফা অস্ত্র উদ্ধারের এক সপ্তাহের মাথায় গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার ঘটনা পুরো বাংলাদেশকে নাড়িয়ে দেয়। সে সময় পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, তুরাগ থানা থেকে দক্ষিণখান থানায় বদলি হওয়া কনস্টেবল শহিদুল ইসলাম ১৮ জুন স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে খালের পাশে বেড়াতে গেলে আকস্মিকভাবে ওই অস্ত্র-গোলাবারুদের সন্ধান পান। খালের পাড়ে নম্বরপ্লেটবিহীন একটি কালো এসইউভি জিপগাড়ি এবং আশপাশে চার-পাঁচজন লোক দেখে শহিদুলের সন্দেহ হয়। খালে কেউ লাশ ফেলছে মনে করে তিনি দ্রুত ওই এলাকা থেকে দূরে সরে যান এবং ফোন করে তুরাগ থানায় খবর দেন। পরে তুরাগ থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে খালে ডুবন্ত অবস্থায় ট্রাভেল ব্যাগ দেখতে পায়। তবে ওই গাড়ি বা অন্য কাউকে পুলিশ সেখানে পায়নি। ওইসব অস্ত্র উদ্ধারের পর খালের পানিতে আরও অস্ত্র আছে কিনা তা দেখতে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি নামিয়ে তল্লাশি চালানো হলে পরদিন আরও তিনটি ব্যাগ পাওয়া যায়। ছয় দিন পর ওই জায়গা থেকে কিছুটা দূরে ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস বোঝাই আরও তিনটি ব্যাগ পাওয়া যায়।