রবিবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা
রাশিয়ার চিঠি

রুশ ভাষার পাঁচালী

শাকিলা সিমকী

মস্কোতে পা রাখার সাথে সাথেই নিজেকে মনে হলো আমি সেই আদিম যুগের মানুষ। আবার পরক্ষণেই মনে হলো আমির খান অভিনীত সেই ‘পিকে’র কথা। মুখের ভাষা হারিয়ে গেছে। ইশারা ইঙ্গিতে কথা বলছি। অন্যের কথা শুনছি আর তাকিয়ে আছি ভ্যালাভ্যালে চোখে। শুধু শুনছিই। কিন্তু কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। এখানে নিজের ভাব প্রকাশের জন্য নিজের মাতৃভাষা তো দূরের কথা অনেক সাধনা করে শেখা ইংলিশ ভাষারও কোনো মূল্য নেই। কারণ এদের সবকিছু চলে রুশ ভাষায়। ইংলিশ এর ধার-ধারে না এরা। সুতরাং রুশ ভাষা না জানা থাকলে আপনাকে বোবা অর্থাৎ নন-ভারবাল কমিউনিকেশন দিয়ে বোঝানো ছাড়া উপায় নেই। আর বলে রাখি  সেটাও খুব বেশিক্ষণ চালাতে পারবেন বলে মনে করবেন না। প্রথম দিন মস্কোতে পা রাখার সাথে সাথে অসহায় মনে হচ্ছিল নিজেদের। এখানে বিলবোর্ড থেকে শুরু করে যতরকমের লেখাজোখা আছে সব ‘রুশকি ইজবিক’ অর্থাৎ রুশ ভাষা। সাথে একজন বাঙালি স্টুডেন্ট থাকার কারণে বেঁচে গিয়েছিলাম সেদিন। মুখের ভাষা আবিষ্কার হবার আগের সময়টার মানুষদের কথা ভেবে দুঃখিত বোধ করছিলাম তাদের জন্য। আবার গুগল ট্রান্সলেটর আবিষ্কারকে ধন্যবাদ দিচ্ছিলাম মনে মনে। কারণ ভাষাগত এই প্রতিবন্ধকতা থেকে আমাদের বাঁচিয়েছিল গুগল ট্রান্সলেটর। তবে এ সাময়িক ব্যবহারের জন্য। যাদের এখানে দীর্ঘ সময়ের জন্য আসতে হয়, ভাষা শেখা তাদের জন্য প্রযোজ্য। সুতরাং এখানে বিভিন্ন দেশ থেকে যারা পড়তে আসে তাদের এক বছর রুশ ভাষার ওপর পড়াশোনা করা বাধ্যতামূলক। তাই স্কলারশিপের অংশ হিসেবে সোশ্যাল স্টেট ইউনিভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল ল্যাঙ্গুয়েজ বিভাগে আমরাও শুরু করলাম রুশ ভাষা শিক্ষা কোর্স।  রাশিয়ার ১৬০টি নৃগোষ্ঠী রয়েছে যারা একশ রকমের ভাষা ব্যবহার করে। তবে শতকরা আশি ভাগ লোকই রুশ ভাষা ব্যবহার করে। এখানকার লোক ইংরেজি না জানাকে অজ্ঞতা মনে করে না। এখানে ইংরেজি না জানলে ভালো চাকরি মিলবে না কিংবা আনস্মার্ট আখ্যায়িত হয় না। তারা নিজেদের ভাষাকে বেশ সম্মানের সঙ্গেই ব্যবহার করে। তবে এখনকার তরুণ  জেনারেশন কিছুটা ইংলিশ জানে বলে মনে হয়েছে কথা বলে। আজকাল নাকি স্কুলগুলোতে সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে ইংলিশ শেখানো হচ্ছে রুশ বাচ্চাদের। বাঙালি হিসেবে রুশ ভাষা না জানার কারণে ‘গুগল ট্রান্সলেটর’ হয়ে উঠল আমাদের বন্ধু। ভাগ্য ভালো আমাদের ল্যাঙ্গুয়েজ টিচার বারবারা আন্দ্রেইভিচ ভালো ইংলিশ জানেন। রুশ ভাষা শেখাটা আরেক অভিজ্ঞতা। এদের বর্ণমালা  দেখে মাথা চক্কর দিল। আরবি, ইংলিশ, গ্রিক বর্ণমালার এক মহাসম্মিলন। নিজেকে মনে হলো ‘তারে জামিন পার’ সিনেমায়  ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত সাত বছরের সেই ছোট্ট ইশান। ইশানের মতো আমার কাছেও সব বর্ণমালা ঘুরপাক খাচ্ছিল। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো শুধু আমার নয়, আমার সঙ্গীদেরও একই অবস্থা। কারণ এখানে ইংরেজি কিছু বর্ণমালা আছে  যেগুলো সত্যিই উল্টো। সুতরাং নিশ্চিত হলাম যাক! আমি ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত হইনি! অনেক আগে পড়া একটি গল্পের কথা মনে পড়ে গেল। গল্পটা ছিল এমন,

রাশিয়ান দুই সৈনিকের মধ্যে কথা হচ্ছে-

প্রথম সৈনিক হিব্রু ভাষাটা শেখা দরকার।

দ্বিতীয় সৈনিক হিব্রু ভাষা কেন?

প্রথম সৈনিক - স্বর্গে নাকি হিব্রু ভাষা চালু আছে।

দ্বিতীয় সৈনিক আচ্ছা, তুই বুঝি স্বর্গে যাবি? নরকে গেলে কী করবি?

প্রথম সৈনিক, কেন রুশ ভাষা জানা আছে তো। 

তখন বুঝিনি এর অর্থ। কিন্তু এখানে এসে এতদিন পর আমি এই গল্পের মানে বুঝলাম। সেই যাই হোক নিজেকে ডিসলেক্সিয়ার রোগী ভাবার কারণটা একটু বলতে চাই। রুশ বর্ণমালা নিয়ে একটু কথা বলতে চাই। এখানে বর্ণমালাকে বলা হয় আলফাভিত। রুশ ৩৩টি বর্ণমালার মধ্যে ১৪টি অক্ষরই ইংরেজি বর্ণমালা। ‘অ ই ঊ ঈ ক গ ঐ ঙ চ ঞ ণ ঢ এই হলো ১২টি। আরও দুটি বর্ণমালা হচ্ছে জ এবং ঘ। এই দুটোকে আলাদা করে বলার কারণ হচ্ছে এই দুটো অক্ষর উল্টোভাবে ব্যবহার হয়। অর্থাৎ জ হয় উল্টো ? তখন যার উচ্চারণ হয় ইয়া আর ঘ তখন ব্যবহৃত হয় উল্টো ? উচ্চারিত হয় ইই। আবার চ যাকে জন্মের পর ইংরেজি শব্দ শেখার পর থেকে জানি প। সেই প এখানে হয়ে গেল জ (আর)। আবার যেই ঐ (এইচ) কে জানি এইচ সেই এইচ উচ্চারিত হয় এখানে এন (ঘ)। ঢ হয় হ আর ণ উ। আমি নিশ্চিত আপনাদের মাথা ঘুরছে। আমি ভাবছি পরবর্তীতে ইংরেজি অক্ষরে আমার যে বিভ্রম ঘটবে সেটা নিশ্চিত। তখন কেউ আমাকে পাগল ভাববেন না যেন। এত গেল অক্ষরের পাট। অক্ষরের কিছু ভিন্নতা থাকলেও ইংরেজি আর বাংলা শব্দের কিছু সাদৃশ্যও রয়েছে। যেমন, আগুন। অতিমাত্রায় ভালো অর্থে। আবার চা কে এরাও চায়ে বলে। কফি কে কফি, ইউনিভার্সিতি, স্তোল,  তেলিফোনা, এটা কে এতা, কম্পিউতার এরকম অনেক মিলও রয়েছে।

এখানে ভাষায় আছে লিঙ্গ। বাংলা এবং ইংরেজি ভাষায় কেবল মাত্র প্রাণিবাচক শব্দকে স্ত্রী এবং পুংলিঙ্গে ভাগ করা হয়। এবং বস্তুবাচক বিষয়কে ক্লীবলিঙ্গ ধরা হয়। কিন্তু রুশ ভাষায় বস্তু এবং প্রাণিবাচক উভয় শব্দকেই সমানভাবে স্ত্রী এবং পুংলিঙ্গ করা হয়। এখানে স্ত্রীবাচক পুরুষবাচক এবং ক্লীবলিঙ্গ শব্দের বস্তুগত রূপ দিয়ে নির্ধারণ করা কঠিন। শব্দের শেষের অক্ষর-এর ওপর নির্ধারিত হয় এর লিঙ্গ। এবং প্রতিটি বাক্য  লিঙ্গ-এর ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয়। যেমন সে (ছেলে) মানে ‘অন’ ‘আর সে (স্ত্রী) ‘অনা’ এবং বই মানে ‘কানিগা’। কানিগা স্ত্রী-লিঙ্গ সুতরাং কানিগা অনা। সে অর্থে যদি বলি ‘গিদিয়ে কানিগা?’ (বইটি কোথায়?) উত্তরে বলব, ‘অনা তুত’ (বইটি এখানে)। বাংলা ভাষায় বা ইংরেজি ভাষায় আমরা নিশ্চয় বস্তুকে ইট বা ইহা বলব। আবার ‘স্তোল’ মানে টেবিল পুরুষবাচক শব্দ। তাহলে বাক্যটি হবে এতা মই স্তোল অর্থাৎ এটা আমার টেবিল। সেক্ষেত্রে আমি মেয়ে বা ছেলে সেটা বিষয় না। টেবিল পুরুষবাচক শব্দ বলে মাইয়ো এর পরিবর্তে মই হবে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে বাংলা এবং ইংরেজি ভাষায় যেমন অতীত (পাস্ট) বর্তমান (প্রেজেন্ট) এবং ভবিষ্যৎ (ফিউচার) টেন্স এবং পারফেক্ট টেন্স-এর ব্যবহার হয়। কিন্তু রুশ ভাষায় পারফেক্ট টেন্স-এর ব্যবহার নেই। শুধু অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎকালের ব্যবহার আছে।

রুশ জাতি তাদের নিজেদের ভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় কথা বললে বেশ বিরক্ত  বোধ করে। তাদের ভাষার মধ্যে এক ধরনের ছন্দ আছে। এক ধরনের শারীরিক এক্সপ্রেশন আছে। তারা কথা বলার সময় তাদের শরীরকে ব্যবহার করে। আমি হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকি যখন তারা কথা বলে। নতুন নতুন শব্দ আর অক্ষর চেনার পর যেখানে লেখা পাই সেখানেই পড়ার চেষ্টা করি। মন কিছুতেই সায় দেয় না পি কে র আর এন কে এইচ উচ্চারণ করতে। সেই আমি এখন তাই করি। নতুন শব্দ শেখায় এক ধরনের আনন্দ আছে। সেই আনন্দ আমি প্রতি মুহূর্তে উপভোগ করছি। সেই আনন্দের অংশ হিসেবেই আমার এই লেখা পাঠকদের সাথে ভাগ করে নিলাম। রাশিয়ার সেই  সৈনিকের মতো স্বর্গে যাবার হিব্রু ভাষাটা না শিখলেও তার ভাষ্যমতে নরকে যাওয়ার ভাষাটাতো শিখতে পারছি। সেটাই বা কম কীসে!!! মস্কো হতে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর