শিরোনাম
মঙ্গলবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

সেই হাসপাতালটির দুর্দশা কাটেনি

ফারুক আল শারাহ, লাকসাম (কুমিল্লা)

সেই হাসপাতালটির দুর্দশা কাটেনি

কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলার গোহারুয়ায় ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০ শয্যাবিশিষ্ট সরকারি হাসপাতাল স্থাপিত হলেও জনবল ও যন্ত্রপাতি সংকটে চিকিৎসাসেবা চালু নেই। হাসপাতালটি উদ্বোধনের ১৩ বছরেও চিকিৎসাসেবার সুফল পায়নি চার উপজেলার সীমান্ত এলাকার লক্ষাধিক মানুষ। দ্রুত হাসপাতালটিতে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাসেবা চালুর দাবি স্থানীয়দের।

সূত্রে জানা যায়, ২০০৪ সালের ১৫ এপ্রিল নাঙ্গলকোট উপজেলার জোড্ডা পশ্চিম ইউনিয়নের গোহারুয়া গ্রামে ২০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। উপজেলার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে হাসপাতালটির অবস্থান হওয়ায় নাঙ্গলকোট, সোনাইমুড়ী, মনোহরগঞ্জ ও সেনবাগ উপজেলার সীমান্ত এলাকার লক্ষাধিক মানুষ এ হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা পাওয়ার আশায় প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে থাকেন। দুই বছর পর ২০০৬ সালের ১৩ জুন গোহারুয়া ২০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের নির্মাণকাজ শেষ হয়। ওই বছরের ১৭ অক্টোবর জনবল নিয়োগ না করেই তৎকালীন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী আমান উল্লাহ আমান হাসপাতালটির বহির্বিভাগ উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনের দুই মাসের মধ্যে জনবল সংকট ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাবে হাসপাতালটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর কেটে যায় বছরের পর বছর। দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকায় হাসপাতাল এলাকা ঝোপ-জঙ্গলে ছেয়ে যায়। চারদিকে সীমানাপ্রাচীর না থাকায় হাসপাতালটি গোচারণভূমিতে পরিণত হয়। ২০১৪ সালের ৪ জুন হাসপাতালটি পূর্ণাঙ্গভাবে চালুর জন্য কুমিল্লা জেলা সিভিল সার্জন মুজিবুর রহমান স্বাস্থ্য সচিবের কাছে চিঠি দেন। চিঠিতে জনবল নিয়োগসহ বিভিন্ন সমস্যার কথা উল্লেখ করা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে চিকিৎসকের ছয়টি এবং নার্স ও কর্মচারীর ছয়টি পদ অনুমোদন দেওয়া হয়। বিভিন্ন পদে আরও জনবল প্রয়োজন থাকলেও নিয়োগ দেওয়া হয়নি। রোগীদের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও সরবরাহ করা হয়নি। অন্তর্বিভাগে চিকিৎসার জন্য ছিল না কোনো শয্যা। সংকট আর সমস্যা থেকেই যায়। সরকারি চিকিৎসাবঞ্চিত এলাকাবাসীর কথা বিবেচনায় নিয়ে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম হাসপাতালটি দ্রুততম সময়ের মধ্যে চালু করতে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমকে অনুরোধ করেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নির্দেশে ওই বছরের ২২ অক্টোবর স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক প্রফেসর ডা. দ্বীন মোহাম্মদ নুরুল হকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল হাসপাতালটি পরিদর্শন করে সংশ্লিষ্টদের চিকিৎসাসেবা চালুর নির্দেশ দেন। ওই সময় স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের সহকারী প্রকৌশলী শওকত মহীবুর রব হাসপাতালটি পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করার জন্য ২ কোটি ৫৪ লাখ ৭৫ হাজার ৬০১ টাকা বরাদ্দ চান। কিন্তু ওই বরাদ্দ না দেওয়ায় প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিসহ বিভিন্ন সমস্যা থেকে যায়। নানা সংকট ও সমস্যার মধ্যে ২০১৫ সালের ৫ নভেম্বর পুনরায় হাসপাতালটি উদ্বোধন করা হয়। স্বাস্থ্য অধিদফতরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক ডা. আলাউদ্দিন মজুমদার, চট্টগ্রাম বিভাগীয় সহকারী পরিচালক ডা. মোহাম্মদ সালাউদ্দিন ও কুমিল্লা জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. মজিবুর রহমান হাসপাতালটি উদ্বোধন করেন। দ্বিতীয় দফায় হাসপাতালের বহির্বিভাগ উদ্বোধন করা হলেও চিকিৎসাসেবার চিত্র ছিল বেহাল। চিকিৎসক ও নার্সরা তাদের খেয়ালখুশিমতো আসতেন-যেতেন। ছিল না প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। নিয়োগপ্রাপ্ত দু-একজন চিকিৎসক তাদের সুবিধামতো এলেও ধীরে ধীরে তারাও আসা বন্ধ করে দেন। এর পর থেকে উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (সেকমো) আজিজুর রহমান ও ওয়ার্ডবয় রাকিবুল হাসান জোড়াতালি দিয়ে সপ্তাহে দু-তিন দিন চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছেন। তবে ২০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে সরকারের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত কোনো এমবিবিএস চিকিৎসক চিকিৎসাসেবা না দেওয়ায় রোগীরা ক্ষোভে হাসপাতালে আসা বন্ধ করে দিয়েছেন। এরই মধ্যে ২০১৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও পরিকল্পনামন্ত্রী, স্বাস্থ্য সচিব, স্বাস্থ্য বিভাগের মহাপরিচালক গোহারুয়া ২০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। ওই সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাসপাতালটি পুরোদমে চালু করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চাহিদাপত্র পাঠানোর জন্য নির্দেশ দেন। চাহিদাপত্র পাঠানো হলেও তা এখন পর্যন্ত পূরণ না হওয়ায় হাসপাতালটি চালু করা সম্ভব হয়নি। গোহারুয়া ২০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাসেবা চালু না হওয়ায় এলাকার মানুষকে মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়ে নাঙ্গলকোট, লাকসাম ও কুমিল্লায় যেতে হয়। এতে অর্থ ও সময় দুটোই ব্যয় হয়। হাতের নাগালে সরকারি-বেসরকারি বিকল্প কোনো চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান না থাকায় ওই এলাকার রোগীদের দূর-দূরান্তের হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসাসেবা নিতে হয়। অনেক সময় মুমূর্ষু রোগীদের বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুও ঘটে। প্রতিষ্ঠার ১৩ বছরেও হাসপাতালটিতে চিকিৎসাসেবার সুফল না পাওয়ায় এলাকাবাসীর মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। সীমান্ত এলাকার চার উপজেলার মানুষের সুচিকিৎসা নিশ্চিতের লক্ষ্যে দ্রুত হাসপাতালটির অন্তর্বিভাগ ও বহির্বিভাগ চালুর দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। গোহারুয়া গ্রামের এনামুল হক ভূঁইয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নাঙ্গলকোটের সীমান্ত এলাকায় গোহারুয়া হাসপাতালটি স্থাপিত হওয়ায় চার উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ সহজে প্রত্যাশিত চিকিৎসাসেবা পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন। কিন্তু দুই দফায় হাসপাতালটির বহির্বিভাগ চালু হলেও জোড়াতালি দিয়ে চিকিৎসাসেবা অল্প কিছুদিন স্থায়ী ছিল। এলাকাবাসীর সুচিকিৎসা নিশ্চিতে দ্রুত হাসপাতালটি চালুর দাবি জানান তিনি। নাঙ্গলকোট উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. দেবদাস দেব বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, হাসপাতালটির সীমানাপ্রাচীর না থাকায় নিরাপত্তার বিষয়টি বড় একটি সমস্যা। হাসপাতালটি উদ্বোধনের পর থেকে এখনো অন্তর্বিভাগ চালু হয়নি। বর্তমানে উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (সেকমো) দিয়ে বহির্বিভাগ চালু রয়েছে বলে তিনি জানান। কুমিল্লা জেলা সিভিল সার্জন মো. মুজিবুর রহমান হাসপাতালটিতে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাসেবা চালুর উদ্যোগ অব্যাহত আছে জানিয়ে বলেন, ‘চিকিৎসকের পদায়ন এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি না থাকায় শতভাগ চিকিৎসাসেবা চালু করতে বিলম্ব হচ্ছে। তবে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বহির্বিভাগ চালু আছে। সারা দেশে এ রকম ৬৫টি হাসপাতাল রয়েছে। আশা রাখছি শিগগিরই সারা দেশের হাসপাতালগুলোর সঙ্গে এ হাসপাতালেও পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাসেবা চালু হবে।’

সর্বশেষ খবর