শনিবার, ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

এক জাদুঘরের নীরব আর্তনাদ

মাহবুব মমতাজী, দিনাজপুর থেকে ফিরে

এক জাদুঘরের নীরব আর্তনাদ

বেলা তখন সাড়ে ১২টা। লোকভবনের সামনে ব্যস্ত রাস্তা। এক দোকানিকে মিউজিয়ামের (জাদুঘর) কথা জিজ্ঞাসা করতেই অবাক চোখে চেয়ে রইলেন। আরেক দোকানিকে জিজ্ঞাসা করেও হতাশ হতে হলো। দেশের তৃতীয় বৃহত্তম সংগ্রহশালা দিনাজপুর মিউজিয়ামের খোঁজ দিনাজপুরের মানুষেরই অজানা! অবশেষে ষাটোর্ধ্ব এক ব্যক্তি লোকভবনের পেছনে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। পাশ দিয়ে মালদহপট্টির রাস্তায় একটু এগিয়েই হতবাক! রাস্তার পাশেই দোতলা ভবন। সামনের চত্বরে একটা পুরনো কামান। জীর্ণ। কামানটার পেছনে এক অংশে হেমায়েত আলী হলে বেসরকারি এক পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট। পাশে ওপরতলায় পাবলিক লাইব্রেরি। নিচে জাদুঘর। বন্ধ দরাজার সামনে গোটা তিন মোটরবাইক পার্ক করা। জীর্ণ ভবন। খসে পড়ছে ইট-সুরকি, পলেস্তারা। দেয়াল আঁকড়ে বেড়ে উঠছে গাছের শিকড়। বারান্দায় অবহেলায় পড়ে আছে মূল্যবান বিভিন্ন প্রত্নবস্তু। নীরবে হাহাকার ছড়াচ্ছে যেন। খোঁজখবর নেওয়ার জন্যও কাউকে খুঁজে পাওয়া গেল না। বাইরে এসে সামনের মোড়ে শাপলা চত্বরে একটু খোঁজ পাওয়া গেল। একটা হার্ডওয়ারের দোকানে। ফিরে গিয়ে শুরু হলো বন্ধ গ্রিলের তালা ধরে বাড়ি দেওয়া। এক দুই করে মিনিট কাটে। কারও কোনো সাড়া নেই। মিনিট পনেরো পর কেউ একজন এলেন। নাম মাহমুদুন্নবী। বললেন, তিনটার পর আসেন। সোয়া ৩টায় ফোন করে মিউজিয়ামের দরজা খোলার নিশ্চয়তা পাওয়া গেল। বিশাল হলরুম। আলোকবাতি ভিতরটাকে খুব একটা উজ্জ্বল করতে পারেনি। পাকা মেঝে কিছুটা উঁচু করে প্রত্নবস্তু গাদা করে রাখা। প্রতিটিতেই ধুলার আস্তর। কালো, শ্বেত, বেলে, লালচে ইত্যাদি পাথরের বিভিন্ন মূর্তি। কালো পাথরের মূর্তিগুলোর অন্যতম- পঞ্চগড়, চিরিরবন্দর, কালুপীরের বাজার, পীরগঞ্জ, বিরামপুরের চাপড়া থেকে সংগ্রহ করা বিষ্ণুমূর্তি। দিনাজপুরের কোতোয়ালি থেকে পাওয়া বিষ্ণু, গণেশ ও সূর্যমূর্তি। খানসামার জৈনমূর্তি। বেলে পাথরের মূর্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম- বিরলের রামচন্দ্রপুরের সূর্যমূর্তি, কাহারোলের চামুন্ডামূর্তি, চাপড়ার মনসামূর্তি, পার্বতীপুরের গৌরিমূর্তি। শ্বেতপাথরের মধ্যে রয়েছে- রাণীশংকৈলের কৃষ্ণমূর্তি, নবাবগঞ্জ ও বোচাগঞ্জের বুদ্ধমূর্তি। আরও আছে রাণীশংকৈলের লালচে পাথরের হনুমানমূর্তি, শ্বেতপাথরের শিবমূর্তি, বোচাগঞ্জের কাঠের যশোদামূর্তি। কালো, ধূসর, বেলে ইত্যাদি পাথরের বিভিন্ন মূর্তির ভগ্নাংশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এখানে ওখানে। আছে ভূর্জ ও তালপত্র এবং তুলট কাগজে হাতে লেখা সংস্কৃত ও বাংলা পা-ুলিপি, বিভিন্ন আমলের প্রাচীন মুদ্রা, নানা আকৃতির জংধরা যুদ্ধাস্ত্র। এই জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা প্রত্নতত্ত্ববিদ আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া। দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক থাকাকালে ১৯৬৮ সালে তিনি এ জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেন। নাম রাখেন দিনাজপুর মিউজিয়াম। বৃহত্তর দিনাজপুরের বিভিন্ন প্রত্নসাইট থেকে খুঁজে পেতে নানা প্রত্ননিদর্শন এনে জমা করেন তিনি।

১৯৭০ সালে তার লেখা ‘দিনাজপুর মিউজিয়াম’ গ্রন্থে দেখা যায়, ১৯৬৯ সালেই এ জাদুঘরে সংগৃহীত প্রত্নবস্তুর সংখ্যা ছিল প্রায় ৮০০। এগুলোর অন্যতম হলো পাথর, ব্রোঞ্জ, পিতল ও কাঠের ভাস্কর্য, পাথরের স্তম্ভ ও খিলান, পোড়ামাটির চিত্রফলক, অলঙ্কৃত ইট, বিভিন্ন শাসনামলের মুদ্রা, অস্ত্রশস্ত্র। আরও ছিল আরবি, ফারসিসহ বিভিন্ন ভাষায় উৎকীর্ণ শিলালিপি, ইষ্টকলিপি, দলিলপত্র, ভূর্জ ও তালপত্র, তুলট কাগজে সংস্কৃত ও বাংলায় হস্তলিখিত পা-ুলিপি, কোরআন শরিফ, চিত্রকর্ম, আসবাব ও তৈজসপত্র। বিভিন্ন প্রত্ননিদর্শনের মধ্যে সীতাকোট বিহার খননে পাওয়া প্রত্নবস্তুর ছিল বিশেষ সমাহার। ১৭টি ব্রোঞ্জমূর্তির মধ্যে ছিল দুটি করে বুদ্ধ, বিষ্ণু ও হরগৌরি মূর্তি, চারটি অপরিচিতা ও একটি যুগল নারীমূর্তি। একটি সপ্তবাসুকি পরিবৃত পুরুষ, দুটি সূর্য ও একটি অপেক্ষাকৃত আধুনিককালের নারীমূর্তি। আরও ছিল সপরিবারে দেবীমূর্তি। আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিযার ওই গ্রন্থেই লেখা আছে, ‘দিনাজপুরের পুরাবস্তুসমূহ বহু পূর্বেই পাচার হয়ে গেছে বিভিন্ন দেশে।’হেমায়েত আলী পাবলিক লাইব্রেরি ও দিনাজপুর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সাধারণ সম্পাদক সাইফুদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘অযত্ন আর অবহেলায় দিনাজপুর জাদুঘরে থাকা বেশির ভাগ নিদর্শন নষ্ট হয়ে গেছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অনেক প্রত্নবস্তু ভেঙে গেছে, ক্ষয়ে নষ্ট হয়ে গেছে।’

শহরের ব্যস্ত রাস্তার পাশে হলেও প্রচারের অভাবে খোদ দিনাজপুরবাসীর কাছেই এ মিউজিয়ামের অস্তিত্ব অনেকটাই অজানা। তাই প্রবেশমূল্য মাত্র পাঁচ টাকা হলেও মাসে ৫০ জন দর্শনার্থীও পাওয়া যায় না। ভবন সংস্কার ও সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের পাশাপাশি ফলপ্রসূ প্রচারে এই মিউজিয়ামকে পর্যটকবান্ধব করার অবারিত সুযোগ রয়েছে। তবে এই জাদুঘরকে আরও উন্নত করার বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন স্থানীয় এমপি জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম।

সর্বশেষ খবর