শনিবার, ২১ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধুকে সর্বময় ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব করি

ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম

বঙ্গবন্ধুকে সর্বময় ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব করি

১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত মনে হয় যেন পঁচিশ যুগ পার করেছি। ফেব্রুয়ারি মাসেই বঙ্গবন্ধু জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দাবি করেছিলেন।  সেই নিরিখে আমাকে এবং ড. কামাল হোসেনকে একটি খসড়া সংবিধান রচনা করতে বলেছিলেন। খসড়াটি নিয়ে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সবার সঙ্গে বসেছিলাম পুরানা পল্টন অফিসে। সংবিধানটি যখন তাদের সামনে পাঠ করছি তখন রেডিওতে বেজে উঠল ইয়াহিয়া খানের ঘোষণা, ‘সংসদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত।’ আমি ছিলাম পার্টির হুইপ। খসড়া সংবিধান অনুমোদনের জন্য আমাকে বলা হয়েছিল দুই হাউসের (জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ) সঙ্গে বসে পূর্বাণী হোটেলে অধিবেশনের ব্যবস্থা করতে। আমরা সব পরিকল্পনা শেষ করলাম। পূর্বাণী হোটেলে যাওয়ার জন্য রাস্তায় নেমে দেখি মানুষ মিছিল নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তুলেছে। স্টেডিয়ামে ক্রিকেট খেলা চলছিল। দর্শক-খেলোয়াড়রাও স্লোগান দিতে দিতে বেরিয়ে আসে। হোটেল ম্যানেজমেন্ট আমাকে জানাল, পাকিস্তান আর্মি তাদের ফোন করে বলেছে অধিবেশন হলে ট্যাংক দিয়ে হোটেল গুঁড়িয়ে দেবে। আমি বললাম, মানুষ রাস্তায় নেমে পড়েছে, চিন্তার কারণ নেই। আমি দ্রুত আমার খাতায় দুটো প্রস্তাব লিখে ফেললাম। একটাতে ইয়াহিয়া খান অধিবেশন স্থগিত করে যে বিশ্বাসঘাতকতামূলক আচরণ করেছেন তার জন্য নিন্দা প্রস্তাব। আরেকটি প্রস্তাব হলো এই পরিবর্তিত অবস্থায় উভয় হাউসের সবার পক্ষ থেকে দেশ পরিচালনার পুরো ক্ষমতা বঙ্গবন্ধুকে অর্পণ করা হলো এবং তিনি যে সিদ্ধান্ত নেবেন তা এই হাউসের সিদ্ধান্ত বলে গৃহীত হবে। দুটো প্রস্তাবই করতালির সঙ্গে পাস হলো। আমরা সাংবিধানিকভাবে ন্যায়সংগত সরকারে পরিণত হলাম। এর ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধু ৩ মার্চে ছাত্রলীগের সম্মেলনে কথা বললেন এবং ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন। এর পর থেকে দেশ চলছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে। বঙ্গবন্ধুর স্টাডি রুম অফিসে পরিণত হলো। সেখানে সারা দেশ থেকে খবর আসত। আমরা দেখলাম বঙ্গবন্ধু যে নির্দেশনা দিচ্ছেন সারা দেশের মানুষ তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে। অসহযোগ আন্দোলনে দেশ অচল করে দিয়েছে মুক্তিকামী মানুষ।

পুরো মার্চ মাস বঙ্গবন্ধুর বাসায় একটি টাস্কফোর্স কাজ করে। তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে আমি এবং ড. কামাল হোসেন সেই টাস্কফোর্সে কাজ করতাম। সব জায়গা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে খসড়া তৈরি করে রাখতাম। পরে সেগুলোর সারসংক্ষেপ বঙ্গবন্ধুকে দেখাতাম। বঙ্গবন্ধু যা নির্দেশনা দিতেন তা পরবর্তী কর্মসূচি হিসেবে সংবাদপত্রে চলে যেত। সব রেকর্ড, নোট সাজিয়ে লিপিবদ্ধ করে রাখতাম।

২৫ মার্চ সকাল থেকেই মনে হচ্ছিল কিছু একটা হবে। রংপুর, গাজীপুরে সাধারণ মানুষকে গুলি করে মারা হচ্ছিল। এ জন্য বঙ্গবন্ধু সকাল থেকেই সব পুলিশ লাইনস, থানা, হেডকোয়ার্টারগুলোতে সংরক্ষিত সব অস্ত্র আমাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে বাঙালি সৈনিকদের মধ্যে বণ্টন করে দিতে বললেন। নির্দেশনা অনুযায়ী রাজারবাগে হাজী গোলাম মোর্শেদকে পাঠানো হলো এসপিকে বঙ্গবন্ধুর বার্তা পৌঁছে দিতে। অন্যান্য জায়গায় টেলিফোন করলাম। সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের একত্রিত হতে বলা হলো। কয়েকজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে বলা হলো। তার পরও অনেককেই জিপে তুলে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি আর্মিরা। সেই কালরাত্রিতে লালমাটিয়ায় রেলের চিফ ইঞ্জিনিয়ার গফুর সাহেবের বাসায় তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে আশ্রয় নিই। বৈশ্বিক জনমত গড়তে বিদেশি সাংবাদিকদের পাঠানো প্রতিবেদন অনেক সহায়ক হয়েছিল। এ জন্য ২৫ মার্চ হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে যেসব সাংবাদিক অবস্থান করছিলেন তাদের বিমানবন্দরে পাঠিয়ে দেশে ফিরে যেতে বলে পাকিস্তানি আর্মি। কিন্তু কয়েকজন সাংবাদিক এটা আগেই বুঝতে পেরে হোটেলের ছাদে পালিয়ে থাকেন। পরবর্তীতে তাদের পাঠানো প্রতিবেদন এবং আমাদের স্টেটমেন্টে পাকিস্তান আর্মির গণহত্যার চিত্র বিশ্বের সামনে উঠে আসে। ১০ এপ্রিল আমরা সরকার গঠন করি। ১৭ তারিখ মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় নতুন সরকার শপথ গ্রহণ করে। ১৭ তারিখের বিষয়টি শুধু জানতেন তাজউদ্দীন সাহেব এবং আমি। কারণ ১০ তারিখেই এটা করার কথা ছিল চুয়াডাঙ্গায়। বিষয়টি ফাঁস হয়ে যাওয়ায় সেখানে বম্বিং হয়। তাই সব গোপন রাখা হলো। ১৭ এপ্রিল সকালে আমি আর মান্নান সাহেব কলকাতা প্রেস ক্লাবে গিয়ে বিদেশি সাংবাদিকদের গাড়িতে করে মেহেরপুরে নিয়ে এলাম। সেখানে মন্ত্রিসভাকে গার্ড অব অনার দেওয়া হলো। বক্তৃতা হলো। সারা পৃথিবী জানল স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন সরকারের খবর। তাজউদ্দীন সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলাম, এই জায়গার নাম কী হবে? তিনি বললেন, মুজিবনগর। অনুলিখন : শামীম আহমেদ।

সর্বশেষ খবর