রবিবার, ৫ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

৩৫ বছরেও এত বেকারত্ব বাড়েনি

-ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর

৩৫ বছরেও এত বেকারত্ব বাড়েনি

করোনা সংক্রমণ যেভাবে বাড়ছে, তাতে অর্থনীতি দ্রুত ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা কম বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা উন্নয়ন অন্বেষণের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর। তার মতে, গত ৩৫ বছরেও বেকারত্ব এত বাড়েনি। কুটির, প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে অর্ধেকের বেশি প্রতিষ্ঠান এবং উদ্যোগ বন্ধ হয়ে গেছে। বিনিয়োগ কমেছে, ভোগ-ব্যয় কমেছে এবং আমদানি-রপ্তানিও কমেছে। অনেক প্রতিষ্ঠানের আয় অর্ধেকে নেমে এসেছে। এক শিল্পনির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থার কারণে করোনা অভিঘাত বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর বেশি পড়েছে। করোনা অসমতা আরও প্রকটতর করবে। বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর। তিনি আরও বলেন, অধিকাংশ মানুষ আয় এবং সঞ্চয়হীন হওয়ায় এক অমানবিক জীবনযাপন করছে। আনুষ্ঠানিক খাতে পাটশিল্প বন্ধের এ সময়ের সিদ্ধান্ত অন্য খাতের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। ইতিমধ্যেই বিপুল সংখ্যক প্রবাসী দেশে ফেরত এসেছেন। অন্য প্রবাসী শ্রমিকদের দেশে ফেরত আসার বাধ্যবাধকতা তৈরি হলে দারিদ্র্য পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে। ইতিমধ্যে আনুষ্ঠানিক খাতে, তথা সেবা খাতের কর্মীদের বেতন ৩১ দশমিক ২ শতাংশ কমেছে। গণপরিবহন এবং আবাসিক পরিষেবা কর্মীদের বেতন কমেছে যথাক্রমে ৪৬ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ। অনানুষ্ঠানিক খাতে যেখানে প্রায় ছয় কোটি মানুষ কাজ করেন, সেখানে প্রভাব আরও প্রকটতর। অর্থাৎ এ অবস্থা চলতে থাকলে, অনেক মানুষ বেকার হবেন এবং আরও বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবেন। নিজের প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন অন্বেষণের এক হিসাব তুলে ধরে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি এক শতাংশ কমলে, বেকারত্ব দশমিক ৯৩ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। সুতরাং জিডিপি কমে যাওয়ার কারণে বেকারত্ব ৩ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এত বেকারত্ব ১৯৮৪ সালের পর আর বাড়েনি। এ সময়ে এটা সর্বোচ্চ বেকারত্বের হার। গত ৩৫ বছরে বেকারত্ব এত বাড়েনি। এভাবে চলতে থাকলে ৪৩ দশমিক ৫ শতাংশ পরিবার আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যসীমার চেয়ে কম আয় করবেন। করোনাভাইরাস অসমতা আরও প্রকটতর করবে। বেকারত্ব বৃদ্ধি পাওয়া এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমজীবীদের আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বৈষম্যের সূচক তথা, গিনি সহগ দশমিক ৩২ থেকে বেড়ে অসহনীয় দশমিক ৫ শতাংশে যেতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের এ অধ্যাপকের মতে, এক শিল্পনির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থার কারণে করোনা অভিঘাত বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর বেশি পড়েছে। কুটির, প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে অর্ধেকের বেশি প্রতিষ্ঠান এবং উদ্যোগ বন্ধ হয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠানের আয় অর্ধেকে নেমে এসেছে। প্রণোদনা প্যাকেজের শর্ত সহজতর না হওয়ার কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি স্তরের উদ্যোক্তারা ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে এখনো ঋণ নিতে পারছে না। নারী উদ্যোক্তারা এ খাতের সব ঋণের কমপক্ষে ১৫ শতাংশ পাওয়ার কথা। এবারের বাজেটেও নারী উদ্যোক্তাদের বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে গেছে। বিনিয়োগ কমেছে, ভোগ-ব্যয় কমেছে এবং আমদানি ও রপ্তানিও কমেছে। অর্থনীতিতে সরকারি বিনিয়োগ বাড়িয়ে সার্বিক চাহিদা বাড়াতে পারলে অর্থনীতি চাঙ্গা হতে পারে। কিন্তু সরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হলে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আয় বাড়ানো দরকার। বর্তমান অর্থনীতির সংকোচনমূলক পরিস্থিতিতে জিডিপির ১০ দশমিক ৪ শতাংশ অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা সম্ভব নয়। ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর মনে করেন, করোনাক্রান্তির সংক্রমণ যেভাবে চলছে, তাতে অর্থনীতি দ্রুত ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা কম। এমতব্যস্থায় জিডিপির ৮ দশমিক ৫ শতাংশের বেশি এনবিআর কর আদায় করতে পারবে না। অন্যদিকে অপ্রয়োজনীয় খরচ কমানোর কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। জনপ্রশাসন খাতে বাজেটের ১৯ দশমিক ৯ শতাংশ বরাদ্দই বড় উদাহরণ। প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি পদোন্নতি ও পদায়ন চলছে। একই সঙ্গে করফাঁকি ও কর জালিয়াতির বিরুদ্ধেও উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। অনেক কর মামলা বিচারাধীন আছে। কোনো সুরাহা হচ্ছে না। এ অর্থনীতিবিদের মতে, সরকারের আয় কম হলে, সরকারি বিনিয়োগও কমে যাবে। অন্যদিকে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ অনেক দিন ধরেই স্থবির। বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপির ১২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ সম্পূর্ণ অসম্ভব। এমন পরিস্থিতিতে সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নিয়ে ঘাটতি অর্থায়ন করতে চেষ্টা করবেন। আগেই তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকিং খাতের অবস্থা আরও নাজুক হবে। পুঁজিবাজারে দীর্ঘদিন ধরেই আস্থার সংকট চলছে। এ মুহূর্তে দরকার প্রতিমুহূর্ত বিবেচনা করে সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কার্যকর পদেক্ষেপ নেওয়া। বাজেটকে প্রতিপ্রান্তিকে পর্যালোচনা করে নতুন পদক্ষেপ নেওয়া। দ্রুত ভিত্তিতে সব অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে আপৎকালীন, স্বল্পমেয়াদি ও মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা করে অর্থনীতির বাঁককে সংকোচনের হাত থেকে পুনবার্সন, পুনর্গঠন ও পুনরুদ্ধার করা।

সর্বশেষ খবর