বৃহস্পতিবার, ১৬ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

তলিয়ে আছে ঘরবাড়ি, নদীও ভাঙছে

নিজস্ব প্রতিবেদক

তলিয়ে আছে ঘরবাড়ি, নদীও ভাঙছে

জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার চিনাডুলির পূর্ববামনা এলাকায় বসতবাড়ির চারপাশ বন্যার পানিতে প্লাবিত হওয়ায় ঘরের সামনে বসে গোসল করছেন এক ব্যক্তি -বাংলাদেশ প্রতিদিন

সপ্তাহের ব্যবধানে দ্বিতীয় দফা বন্যায় মহাসংকটে পড়েছে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোর খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষগুলো। তলিয়ে গেছে ঘরবাড়ি। নদী ভাঙনে অনেকেই হারিয়েছেন শেষ সম্বল। গবাদি পশু নিয়ে পড়েছেন চরম বিপাকে। স্রোতে ভেসে গেছে অনেকের হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল। দীর্ঘদিন পানিবন্দী থাকায় গরু-ছাগলের দেখা দিয়েছে নানা রোগ। কেউ কেউ গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগি নিয়ে উঁচু সড়ক ও বাঁধে আশ্রয় নিতে পারলেও মিলছে না পশুখাদ্য। খাবার দিতে না পেরে অনেকে কোরবানির আগে নামমাত্র মূল্যে মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন সারা বছর স্বপ্ন বুকে নিয়ে লালন করা প্রিয় পশুটিকে। হাঁস-মুরগির খাবার না থাকায় সেগুলোও বিক্রি করে দিচ্ছেন পানির দরে। আবার কেউ নিজেরাই রান্না করে খেয়ে ফেলছেন।

এদিকে ২৪ ঘণ্টায় দেশের কিছু এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অধিকাংশ জেলায় অবনতি হয়েছে। এখনো নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, গতকাল সকাল নাগাদ ১০১টি পানি সমতল স্টেশনের ৫৬টিতে পানি বৃদ্ধি পায়। ১৩টি নদ-নদীর পানি ২১টি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পূর্বাভাসে বলা হয়, আগামী ২৪ ঘণ্টায় সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। অন্যদিকে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁ, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, রাজবাড়ী ও ঢাকা জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। বর্তমানে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোর ১০ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে। খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকটের পাশাপাশি সবচেয়ে বিপাকে আছে গবাদি পশু নিয়ে। কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে এক বছর ধরে পরম যতেœ লালন করা গুরু-ছাগল নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে। হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগলের সঙ্গে গাদাগাদি করে বাস করছে বানভাসিরা। আমাদের বিভিন্ন জেলার সংবাদকর্মীরা জানিয়েছেন গবাদি পশু নিয়ে বানভাসি মানুষের ভোগান্তির খবর- গাইবান্ধা : ঘরবাড়িতে পানি উঠে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে ৩৫টির বেশি গ্রামের মানুষ। দুর্ভোগের মধ্যে পড়ে অনেকে বাড়িঘর ছেড়ে গরু-ছাগল নিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও উঁচু এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন। পশু খাদ্যের অভাব দেখা দেওয়ায় সেগুলো নিয়ে তারা বিপাকে পড়েছেন। সরকারিভাবে পশু খাদ্যের সহায়তা এখনো কেউ পাননি। গতকাল ফুলছড়ি উপজেলার ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বালাসী থেকে সৈয়দপুর এলাকা পর্যন্ত ঘুরে দেখা যায়, সংকীর্ণ বাঁধে টিনের চালা তুলে নিজেদের কোনোমতে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছেন দুই শতাধিক পরিবার। অধিকাংশেরই গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি নিয়ে একই চালার তলায় থাকতে হচ্ছে। ভাষার পাড়া গ্রামের মালেক মিয়া (৬০) বলেন, ‘তিনটা গরু নিয়া বাঁধের ওপর কোনোমতে চালা তুলি আছি। গরুর খড় শেষ হয়া গেছে। নিজের খাবারই জোটে না, গরুক কি খাওয়ামো। কোরবানির হাটে বেঁইচবার জন্য গরু পাইলছি কিন্তু এখন কেনার মতো লোক নাই। হাটও বন্ধ।’ কুড়িগ্রাম : দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে বন্যার কারণে ধরলা ও ব্রহ্মপুত্রসহ সব নদ-নদীর চরের গেরস্থ ও খামারিরা গবাদি পশু নিয়ে চরম সংকটে রয়েছেন। কোনো কোনো জায়গায় লেম্প স্কিন ডিজিজ দেখা দিয়েছে। এসব পশু রাখার জায়গার সংকট দেখা দিয়েছে। দেখা দিয়েছে পশু খাদ্যের সংকট। এ অবস্থায় আসন্ন কোরবানি ঈদকে সামনে রেখে অতি যতেœ লালনপালন করা গরু ও ছাগল অনেক ছাড় দিয়ে বিক্রি করতে বাধ্য হতে হচ্ছেন। গরু নিয়ে যাত্রাপুরের হাটে আসা খামারি জুলফিকার আলী বলেন, আমার যাত্রাপুরের রলাকাটায় চরে বাড়ি। গত এক বছর ধরে সাতটি গরু লালন-পালন করছি কোরবানিকে সামনে রেখে। বন্যার কারণে বাড়িতে পানি ওঠায় এগুলোকে রাখা যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে কম দামে বিক্রি করছি। সিরাজগঞ্জ : বন্যায় তলিয়ে গেছে জমির ঘাস। ভিজে গেছে খড়ের গাদা। গরুগুলোকে ময়লা আবর্জনা আর বালি মাটি দিয়ে উঁচু ঢিবি করে কোনোরকমে রাখা হয়েছে। শুকনো কিছু খড় কেটে মাঝে মধ্যে খাবার দেওয়া হচ্ছে। আগের মতো খাবার না পাওয়ায় গবাদি পশুগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন দৃশ্য দেখা গেছে বন্যাকবলিত সিরাজগঞ্জের কাওয়াকোলা ইউপিসহ জেলার ৩০টি ইউপির চরাঞ্চলের অধিকাংশ বাড়িতে। বসতভিটায় পানি ওঠায় গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগি নিয়ে চরম বিপাকে এসব এলাকার মানুষ। বহু কৃষকের হাঁস-মুরগি নদীতে ভেসে গেছে। অনেকের হাঁস-মুরগি নিজেই ঘরের চালের ওপর আশ্রয় নিয়েছে। বগুড়া : তিনটি উপজেলা বন্যাকবলিত হয়ে পড়ায় কোরবানির আগে খামারিরা তাদের গৃহপালিত গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি নিয়ে একঘরে অবস্থান নিয়েছে। কেউ কেউ আবার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিলেও রাত জেগে পাহারা দিচ্ছে কোরবানিযোগ্য গরু-ছাগল। দ্বিতীয় দফা বন্যায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। পশুখাদ্যের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। তবে সারিয়াকান্দি উপজেলার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা দফতরের তথ্যমতে, ১ হাজার ২০০ পরিবার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে এবং ৯৫০টি পরিবার বন্যার আগেই আশ্রয়ণ প্রকল্প ও গুচ্ছ গ্রামের উঁচু স্থানে আশ্রয় নেওয়ায় তাদের গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগির তেমন ক্ষতি হয়নি।

সুনামগঞ্জ : সুনামগঞ্জে ১৫ দিনের ব্যবধানে টানা দুই দফা বন্যায় জনজীবনে সীমাহীন ভোগান্তির পাশাপাশি গৃহপালিত পশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। জেলায় প্রায় এক লাখ ৫৬ হাজার গৃহপালিত পশু বন্যাকবলিত হয়েছে। হাঁস-মুরগি মিলিয়ে এই সংখ্যা ২৫ লাখ বলে জানিয়েছে জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ। কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে জেলায় ৪৭ হাজার গরু মোটাতাজা করেছিলেন কৃষক ও খামরিরা। দুই দফা বন্যার আঘাতে এসব গবাদি পশু নিয়ে বিপাকে আছেন পশু মালিক। পশু-চারণ ভূমি পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় জেলাজুড়ে দেখা দিয়েছে পশু-খাদ্যের অভাব। এমন পরিস্থিতিতে কম দামেও পশু বিক্রি করতে পারছেন না অনেক কৃষক। নেত্রকোনা : প্লাবিত এলাকার মানুষগুলো নিজেরা কোনো রকম ঘরে থাকার ব্যবস্থা থাকলেও গবাদি পশু নিয়ে তারা দিশাহারা। সড়কে বা আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে রাখছেন তাদের পশুগুলো। অনেকে রাত জেগে পাহারা দিচ্ছেন পশুগুলো। এসব মানুষের অনেকেরই একমাত্র সম্বল গবাদি পশু। ঈদকে সামনে রেখে সারা বছর এগুলো লালন-পালন করেন। এরপর সেটা বিক্রি করেই চলে বছরের বাকিটা দিন।

কিন্তু করোনা আর ঈদের আগে বন্যার কারণে গবাদি পশু নিয়ে দিশাহারা হতদরিদ্র মানুষগুলো।

রংপুর : বন্যার কারণে গৃহস্থদের গরু চলে যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগী দালাল-ফড়িয়াদের কাছে। বন্যায় প্লাবিত এলাকার ছোট খামারি ও গৃহস্থরা ঘরবাড়ি সংস্কার ও ফসলের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে প্রকৃত মূল্যের চেয়ে কম দামে প্রতিটি গরু বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার এমদাদুল মিয়া একটি, দুলু মিয়া তিনটি, ছয়ফল হোসেন তিনটি ও সাজু মিয়া চারটি গরু বিক্রি করে দিয়েছে নামমাত্র মূল্যে। ঈদে ভালো অর্থ পাওয়ার আশায় তারা সারা বছর পরম যতেœ লালন-পালন করেছিলেন গরুগুলো।

নাটোর : চলনবিলের নাটোর অংশ এখন বন্যাকবলিত। এখনো বেশির ভাগ এলাকায় হাঁটুপানি রয়েছে। পানিতে মাঠ-ঘাট, ফসলি জমি এমনকি চাষ করা ঘাসের জমিও ডুবে গেছে। বন্যার পানিতে নষ্ট হয়েছে কৃষকের গচ্ছিত রাখা খড়ও। বানভাসিরা রাস্তা, উঁচু স্থান ও বাঁধে গবাদিপশু নিয়ে আশ্রয় নিলেও পশুখাদ্যের সংকটে ক্রমেই গবাদিপশুগুলো দুর্বল হয়ে পড়ছে। এতে কোরবানির ঈদে গবাদিপশু বিক্রি নিয়ে দুশ্চিন্তায় কৃষক ও খামারিরা।

সর্বশেষ খবর