শনিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

ঢাকার নবাবি ঐতিহ্য আহসান মঞ্জিল

মোস্তফা মতিহার

ঢাকার নবাবি ঐতিহ্য আহসান মঞ্জিল

বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রাজধানী ঢাকা। আর এখানকার নবাবদের জীবনাচরণ, শাসনব্যবস্থা ও তাদের প্রজাহিতৈষীতার কারণেই উপমহাদেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ঢাকার সুনাম ও সুখ্যাতি। ঢাকার ইতিহাস আজও সেই সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। বুড়িগঙ্গার পাড়ে এখনো টিকে আছে নবাবী আমলের সেই চিহ্ন। ঢাকার ৪০০ বছরের প্রাচীন ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে নবাবি আমলের শান-শওকত। আর গর্বিত সেই ইতিহাসের অংশ হিসেবে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নবাবদের নিদর্শন ‘আহসান মঞ্জিল’। কালের বিবর্তনে নবাবি আমল না থাকলেও আহসান মঞ্জিল এখনো ঢাকার নবাবদের আধিপত্য ও শান-শওকতের সাক্ষ্য দিচ্ছে। প্রাসাদের ভিতরে সংরক্ষিত নবাবদের পোশাক-পরিচ্ছদ, খাট-পালঙ্ক, তৈজসপত্র, রৌপ্য, তামার মুদ্রা, লোহার তৈরি নবাবের মূর্তি বর্ণনা দিচ্ছে নবাবি আভিজাত্যের। প্রাসাদের প্রতিটি ইঞ্চিতে ফুটে আছে খানদানি জীবনযাপনের অনন্য উদাহরণ। এককালে নবাব বাহাদুর ও তার পরিবারের সদস্যদের পদচারণায় মুখরিত ছিল প্রাসাদটি। ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, পুত্র খাজা আহসানউল্লাহর প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন স্বরূপ আবাসিক এ বাড়িটি নির্মাণ করেন ঢাকার নবাব আবদুল গনি। ১৮৫৯ থেকে ১৮৭২ অর্থাৎ ১৩ বছরে নির্মিত হয় বাড়িটি। মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি নামক একটি ইউরোপিয়ান প্রকৌশল কোম্পানির দ্বারা এটির নকশা তৈরি করা হয়। প্রাসাদটির নির্মাণশৈলীতে তৎকালীন সর্বাধুনিক ডিজাইনকে

প্রাধান্য দেওয়া হয়। যা বিগত দেড় শতাব্দী পর আজও আধুনিকতার এক নিদর্শন হিসেবে রাজধানী ও সারা দেশের সৌন্দর্যপিপাসু মানুষদের আকৃষ্ট করছে। এ প্রাসাদের ছাদের ওপর সুন্দর একটি গম্বুজ আছে। এক সময় এ গম্বুজের চূড়াটি ছিল ঢাকা শহরের সর্বোচ্চ। মূল ভবনের বাইরে ত্রি-তোরণবিশিষ্ট প্রবেশদ্বারও দেখতে সুন্দর। একইভাবে ওপরে ওঠার সিঁড়িগুলোও সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে দুটি মনোরম খিলান আছে যা দৃষ্টিনন্দন। আহসান মঞ্জিলের অভ্যন্তরে দুটি অংশ আছে। বৈঠকখানা ও পাঠাগার আছে পূর্ব অংশে। পশ্চিম অংশে আছে নাচঘর ও অন্যান্য আবাসিক কক্ষ। নিচতলায় দরবারগৃহ ও ভোজন কক্ষ রয়েছে। প্রাসাদের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে একতলার সমান উঁচু করে গাড়ি বারান্দা। দক্ষিণ দিকের গাড়ি বারান্দার ওপর দিয়ে দোতলার বারান্দা থেকে একটি সুবৃহৎ খোলা সিঁড়ি সম্মুখের বাগান দিয়ে নদীর দ্বার পর্যন্ত নেমে গেছে। সিঁড়ির সামনে বাগানে একটি ফোয়ারা ছিল, যা বর্তমানে নেই। বলা চলে, গাঁথুনিতে আভিজাত্য আর সাজসজ্জায় শৈল্পিকতার কারণে আহসান মঞ্জিল এখনো ঢাকাই সৌন্দর্য্যরে ঐতিহ্য হিসেবে স্থান করে নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়। বুড়িগঙ্গার তীরে আজও জাহাজের হুইসেলের শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়। আজও ঘাটে নোঙর করে জাহাজ। কিন্তু নবাবী আমলের সেই শান-শওকত আজ যেন কল্পনার ক্যানভাসে আঁকা এক দৃশ্যকল্প। তবে নবাবী ইতিহাসের অংশ হয়ে নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকা আহসান মঞ্জিলের প্রতিটি ইট, মেঝে, প্রতিটি কক্ষ আর জিনিসপত্র আজও ঢাকার নবাবদের গৌরবময় ইতিহাসের কথাই বলে যাচ্ছে। স্বাধীনতার পর অযত্ন ও অপব্যবহারে আহসান মঞ্জিল ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে। এমতাবস্থায় ১৯৭৪ সালে ঢাকার নওয়াব পরিবারের উত্তরসূরিরা আহসান মঞ্জিল প্রাসাদ নিলামে বিক্রির পরিকল্পনা করেন। সরকারের ভূমি প্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পক্ষে নিলাম বিক্রির প্রস্তাবটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে পেশ করা হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আহসান মঞ্জিলের স্থাপত্য সৌন্দর্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব উপলব্ধি করে ১৯৭৪ সালের ২ নভেম্বর এটি নিলামে বিক্রির প্রস্তাব নাকচ করে দেন। নবাবী আমলের বিলুপ্তির পর ১৯৮৫ সালের ৩ নভেম্বর তৎকালীন সরকার ঢাকার এ ঐতিহাসিক স্থাপনাটি অধিগ্রহণ করে জাদুঘরের নির্মাণকাজ শুরু করে। এরপর ১৯৯৩ সালের ২০ নভেম্বর এটিকে জাদুঘর হিসেবে দর্শনার্থীদের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। সেই থেকে এ দেশের সৌন্দর্যপিপাসুদের কাছে ‘আহসান মঞ্জিল’ এক ভালোলাগা ও ভালোবাসার নাম। প্রতিদিনই এখানে ভিড় করে কয়েক হাজার সৌন্দর্যপ্রিয় দর্শনার্থী। তবে বৈশ্বিক দুর্যোগ করোনার কারণে সারা দেশের সবকিছুর মতো বন্ধ রয়েছে আহসান মঞ্জিলও। ২৬ মার্চ লকডাউন শুরুর আগের দিন ২৫ মার্চ থেকেই এটি বন্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছে জাদুঘরটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। নিরপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত মোকলেছুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, জাতীয় জাদুঘরের অধীনে এটি একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। জাতীয় জাদুঘর থেকে কোনো নির্দেশনা না এলে এটি খোলা হবে না বলেও জানান তিনি। তবে চলতি মাসের শেষ দিকে খোলার সম্ভাবনা রয়েছে বলেও তিনি জানান। এখানে দুটি ভবন রয়েছে। একটি হচ্ছে ‘প্রাসাদ ভবন’ আর অন্যটি ‘অন্দর মহল’। এর মধ্যে প্রাসাদ ভবনে ২২টি গ্যালারি রয়েছে। আর ২২টি গ্যালারিতে প্রায় ২ হাজারটি শিল্পকর্ম ও নিদর্শন রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে নবাবের ব্যবহৃত খাট-পালঙ্ক, চেয়ার-টেবিল, পোশাক-পরিচ্ছদ, বিভিন্ন ধরনের তৈজসপত্র, তামা ও রূপার মুদ্রাসহ আরও অনেক শিল্পকর্ম। জাদুঘর সূত্র জানায়, ভবনে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে লোহার তৈরি নবাবের মূর্তিটি যেকোনো দর্শনার্থীকে আকৃষ্ট করবে- কিছু সময়ের জন্য হলেও দর্শনার্থীরা নবাবের মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করবে। প্রতিটি গ্যালারির প্রতিটি শিল্পকর্ম ও নবাবী নিদর্শন দর্শনার্থীদের নয়ন জুড়ানোর পাশাপাশি হৃদয়কেও শীতল করবে বলে মনে করেন জাদুঘরটির সঙ্গে জড়িত একাধিক সূত্র। তবে এখানকার মূল শিল্পকর্ম হীরার তৈরি ‘দরিয়া-ই-নূর’ বর্তমানে সোনালী ব্যাংকে সংরক্ষিত থাকার কারণে ‘দরিয়া-ই-নূর’ এর সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারছেন না জাদুঘরে আগতরা। ‘অন্দর মহল’ নামের আরেকটি ভবন সাজানো হয়েছে নবাব ও তার পরিবারের সদস্যদের প্রায় ৫০০ ছবি দিয়ে। শিল্পীর তুলিতে আঁকা নবাব পরিবারের প্রতিটি ছবিই যেন শিল্পের অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। জাদুঘরটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রশাসন, ডিসপ্লে, নিরাপত্তা, সংরক্ষণ, শিক্ষাসহ বেশ কয়েকটি বিভাগের অধীনে জাদুঘরের কার্যক্রমে ৫৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিযুক্ত আছেন। করোনার মহামারীর কারণে আহসান মঞ্জিলের সৌন্দর্য উপভোগ থেকে বঞ্চিতরা চান খুব শিগগিরই দর্শনার্থীদের জন্য এটিকে উন্মুক্ত করে দেওয়া হোক। এখানকার আশপাশের দোকানিরাও এ নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেন। এখানকার দোকানি মোহাম্মদ হীরা বলেন, সবকিছু স্বাভাবিক করে দেওয়া হয়েছে। করোনা থাকলেও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও অফিস-আদালত সবই এখন আগের মতো স্বাভাবিকভাবে চলছে কিন্তু ঢাকার ঐতিহ্য ও গর্ব ‘আহসান মঞ্জিল’কে খুলে দেওয়া হচ্ছে না। এতে করে সৌন্দর্যপিপাসুরা যেমন এটির সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, ঠিক একইভাবে সরকারও রাজস্ব হারাচ্ছে। এ ছাড়া জাদুঘরকে ঘিরে গড়ে ওঠা আমরা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। কারণ এখানে প্রতিদিন  প্রায় ৫ হাজারের মতো দর্শনার্থী ঘুরতে আসেন। আর শুক্রবার ও অন্যান্য ছুটির দিনে প্রায় ১০ হাজার দর্শনার্থী আসেন। ‘আহসান মঞ্জিল’ খোলার বিষয়ে জাতীয় জাদুঘরে মহাপরিচালক খন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জাতীয় জাদুঘরের অধীনে ৯টি জাদুঘর রয়েছে। সরকারি সিদ্ধান্ত আসার পর এগুলো খোলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। জাদুঘর খুলে দিলে লোকসমাগম বেশি হবে, এতে করে করোনার ঝুঁকিও বাড়বে। যার কারণে আমরা এখনো সরকারি সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি। তবে জাদুঘর ট্রাস্টি বোর্ডের পরবর্তী সভায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর