শুক্রবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

সুতার বুননে মিশে আছে স্বপ্ন

বগুড়ার চাদর কম্বল পল্লী

আবদুর রহমান টুলু, বগুড়া

সুতার বুননে মিশে আছে স্বপ্ন

শীতের প্রকোপ বেড়েছে। বেড়েছে বলেই বগুড়ায় গড়ে ওঠা কম্বলের হাট ভরে গেছে ক্রেতা-বিক্রেতায়। ভোর থেকে শুরু হয়ে সূর্য ওঠার আগেই শেষ হয়ে যাওয়া এই কম্বলের হাটে কেনাবেচা হয় লাখ লাখ টাকার শীতের পোশাক। আর পোশাকের কারিগরদের তাঁতের খটর-খট শব্দে সুতার বুননে মিশে আছে স্বপ্ন। শীত পড়ে যাওয়ায় সে স্বপ্ন এখন মেলেছে ডালপালা। জানা গেছে, ১৯৭৭ সাল থেকে আদমদীঘি উপজেলার নশরতপুর ইউনিয়নের শাওইল গ্রামে হাট বসে আসছে। হাটকে কেন্দ্র করে আদমদীঘি, দুপচাঁচিয়া, কাহালু, জয়পুরহাট জেলার আক্কেলপুর এবং নওগাঁ সদর উপজেলার অর্ধশত গ্রামের মানুষ এ পেশার সঙ্গে জড়িত। বগুড়া জেলার আদমদীঘি উপজেলার নশরতপুর ইউনিয়নের ছোট একটি গ্রাম শাওইল। এ গ্রামে ভিন্নধর্মী হাট গড়ে ওঠে। মূলত চাদর-কম্বল এই হাটে বেচাকেনা হয় বলে নাম হয়েছে ‘চাদর কম্বল হাটের গ্রাম’। ভোররাত আনুমানিক ৪টা থেকে শুরু হওয়া এই হাট চলে দুপুর পর্যন্ত। গোটা শীত মৌসুমে প্রায় ৪০টি হাটে ৫০ কোটি টাকার বেচাকেনা হয়। সপ্তাহের রবি ও বুধবার হাটবার হলেও শীতকাল এলে বেচাকেনা হয় প্রতিদিনই। বিভিন্ন গার্মেন্টের পুরনো সোয়েটারের সুতা প্রক্রিয়া করে তাঁতে বুনিয়ে তৈরি হয় কম্বল, চাদর, মাফলার, বেড কভারসহ আনুষঙ্গিক শীতের গরম পোশাক। তাঁতিরা সুতা বোনাসহ গায়ের চাদর, কম্বল, বিছানার চাদর, লেডিস চাদর, লুঙ্গি, গামছা, তোয়ালেসহ নানা ধরনের শীতবস্ত্র তৈরি করেন।

বগুড়া জেলার আদমদীঘি ও দুপচাঁচিয়া উপজেলার অর্ধশত গ্রাম নিয়ে গড়ে ওঠা কম্বল পল্লীতে বছরজুড়ে এসব বস্ত্র তৈরি হলেও শীতকালে চাহিদা বেড়ে যায়। সরকারিভাবে শীতকালে বিতরণকৃত কম্বলের সিংহভাগই উৎপাদিত হয় শাওইল গ্রামে। ১৫০ টাকা থেকে শুরু করে ৩০০ টাকায় পাওয়া যায় কম্বল। আর প্রকারভেদে ১০০ থেকে ৪৫০ টাকায় মেলে চাদর। শাওইলের হাটে দোকান রয়েছে ছোট-বড় মিলিয়ে ১ হাজার ৬০০টি। বগুড়া শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে সান্তাহার-বগুড়া সড়কের মুরইল থেকে ৪ কিলোমিটার উত্তরে এই হাট ও কম্বল গ্রাম। স্থানীয়রা জানান, উন্নতমানের হওয়ায় এই চাদরের চাহিদা বাংলাদেশে ব্যাপক। এখানকার চাদর পৃথিবীর নানা দেশে যায়। বিভিন্ন গার্মেন্টসের সোয়াটারের সুতা প্রক্রিয়া করে তাঁতে বুনিয়ে তৈরি হয় কম্বল, চাদরসহ আনুষঙ্গিক পণ্য। কোনো ধরনের প্রচার ও সহযোগিতা ছাড়াই এখানে গড়ে উঠেছে বিশাল এই কর্মক্ষেত্র। চাদর তৈরির পাশাপাশি এখানে গড়ে উঠেছে শীতবস্ত্র তৈরির মেশিন, সুতা, রং, তাঁতের চরকা, তাঁত মেশিনের সরঞ্জাম ও লাটাইয়ের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বাজারের আশপাশে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় অনেক দোকান। দোকানগুলোতে বেচাকেনায় নিয়োজিত কয়েক হাজার শ্রমিক। সপ্তাহের দুই দিন রবি ও বুধবার ভোর থেকে বিকিকিনি শুরু হয় হাটে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শত শত ক্রেতা আগের দিন এসে অবস্থান নেন হাটের আশপাশের বিক্রেতাদের বাড়িতে। সকাল ১০টার মধ্যেই চাহিদামতো পণ্য কিনে ক্রেতারা রওনা দেন গন্তব্যে।

হাটের ইজারাদাররা জানান, প্রতি হাটে প্রায় কোটি টাকার কম্বল, চাদর, উলের সুতা বিক্রি হয় এখানে। হাট ঘিরে কর্মসংস্থান হয়েছে শত শত মানুষের। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশ থেকে আসা ব্যবসায়ীরা চাদর, কম্বল আর সুতা কিনে নিয়ে যান। ব্যবসায়ী আশরাফুল ইসলাম জানান, শীতার্তদের মধ্যে যারা কম্বল বিতরণ করেন, তাদের অধিকাংশই জানেন শাওইল গ্রামের কম্বলের হাটের কথা। এখানকার নেতা শাল ৬ হাত লম্বা, যার মূল্য ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, লেডিস চাদর ৮০ থেকে ৪৫০ টাকা, প্রকারভেদে অন্যান্য চাদরের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন দাম।

শাওইল হাট ও বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন জানান, প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত লট থেকে সুতা বাছাই, ফেটি তৈরি কিংবা সুতা সাজিয়ে রাখা হয়। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এখানে সুতা নিতে আসেন ক্রেতারা। বিসিক বগুড়ার উপমহাব্যবস্থাপক জাহেদুল ইসলাম সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের বিষয়ে সার্বিক সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন।

সর্বশেষ খবর