সোমবার, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

ছেঁড়া কাগজ বিকৃত মরদেহ

গল্পের গোয়েন্দারা লেখকের কলমের খোঁচায় অসাধ্য সাধন করেন। কিন্তু বাস্তবের গোয়েন্দারা? অপরাধীকে ধরতে তাদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ও সূক্ষ্ম বুদ্ধি ভরসা। উন্মোচনের দ্বারপ্রান্তে এগিয়ে যায় ক্লু-লেস অপরাধের রহস্য। এমনই কিছু ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে আলোচিত ‘গোয়েন্দা কাহিনি’র দ্বিতীয় পর্বে

মির্জা মেহেদী তমাল

ছেঁড়া কাগজ বিকৃত মরদেহ

অন্ধকার থাকতেই স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন শহরের বিভিন্ন সবুজ উদ্যান আর ফাঁকা সড়কগুলোতে। প্রাতঃভ্রমণের জন্য জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ঢাকার হাতিরঝিলে ভোরের আলো ফোটার আগেই লোকজন আসতে শুরু করে। প্রতিদিনের মতো সেদিনও হাতিরঝিলের চারপাশজুড়ে বিপুলসংখ্যক মানুষ। যে যার মতো শারীরিক ব্যায়াম আর প্রাতঃভ্রমণে ব্যস্ত সবাই। শুধু হাতিরঝিল লেকের মেরুল বাড্ডা প্রান্তে মানুষের মধ্যে হঠাৎ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। মানুষের জটলা সেখানে। লেকের পানিতে ভাসছে একটি বস্তা। মানুষের শরীরের কিছু অংশ বেরিয়ে এসেছে। এ খবর এক কান-দু কান করে ছড়িয়ে পড়ে মুহূর্তে। পুলিশের কাছেও সংবাদ চলে যায়। হাতিরঝিলে ইতিমধ্যে ঝকঝকে রোদ। হাতিরঝিল থানা পুলিশের একাধিক গাড়ি দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। লোক চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। সাতসকালে বস্তাবন্দী লাশের খবরে পুলিশ উদ্বিগ্ন। পুলিশ বস্তাটি উদ্ধার করে। বস্তার মুখ খুলতেই উৎকট গন্ধ। যুবকের অর্ধগলিত লাশ। হাত-পা রশি দিয়ে বাঁধা। বেডশিট, মশারি ও পলিথিনে মোড়ানো পুরো শরীর। মুখমন্ডল, হাত, আঙুল ও শরীরের বিভিন্ন স্থান বিকৃত। লাশ দেখে পুলিশ কর্মকর্তাদের ধারণা, খুনিরা খুব ধূর্ত। যেন চেনা না যায় এ কারণে মুখমন্ডল বিকৃত করে দেওয়া হয়েছে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে যেন পরিচয় শনাক্ত করা না যায়, সে কারণে আঙুলও থেঁতলে দিয়েছে খুনিরা। ক্লু-লেস এই খুনের ঘটনাটি নিয়ে পুলিশ চিন্তিত। পরিচয় শনাক্ত না করা পর্যন্ত খুনিদের গ্রেফতার করাটা কঠিন হয়ে পড়বে। আর তাদের গ্রেফতার করতে হলেও যে কোনো সূত্রের প্রয়োজন। এমন সূত্রের সন্ধানেই নামে পুলিশের দল। তাদের এই অনুসন্ধান শুরু হয় হাতিরঝিল লেক থেকেই। ঘটনাটি ২০২০ সালের ১২ অক্টোবরের।

পুলিশ হাতিরঝিল লেকে যে স্থানে লাশটি পাওয়া যায়, সেখানেই তল্লাশি শুরু করে কোনো সূত্রের আশায়। লেকের পাড়ে পুলিশ খুঁজে পায় একটি ছেঁড়া কাগজ, যাতে লেখা রয়েছে একটি মোবাইল ফোন নম্বর। ছেঁড়া কাগজটি তুচ্ছ মনে হলেও চৌকস কর্মকর্তা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকার অতিরিক্ত উপকমিশনার হাফিজ আল ফারুকের কাছে তা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সেই ছেঁড়া কাগজটি সম্বল করেই তদন্ত শুরু করেন। লাশের পরিচয় ও খুনের রহস্য উন্মোচন থেকে শুরু করে খুনি গ্রেফতার- সবকিছুই সহজ হয়ে যায় ওই ছেঁড়া কাগজটির কারণে।

যেভাবে শুরু : আজিজুল ইসলাম মেহেদী। ২৪ বছরের এই ছেলেটি আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম (আইআইইউসি) থেকে ইংরেজি বিভাগে ¯œাতক শেষ করে মাস্টার্সে পড়াশোনা করছিলেন। মেধাবী মেহেদী এর আগে ‘ইউনাইটেড ন্যাশনস’-এর হয়ে সফর করেছেন মালয়েশিয়া ও কানাডা। এই দুই দেশের মধ্যে কানাডা বেশ ভালো লেগেছিল মেহেদীর। তাই তো সেই সফর শেষে পরিবারের সবার ছোট ছেলেটি মা জাহানারা বেগমের কাছে আবদার করে বসেন কানাডায় পড়ালেখা করার। একমাত্র ছেলের এই আবদারের কথা আমেরিকা প্রবাসী বাবা ফখরুল ইসলামকে জানান মা জাহানারা বেগম। আলোচনা করেন মেহেদীর বড় দুই বোন ও তাদের স্বামীদের সঙ্গে। পরিবারের সবার সিদ্ধান্ত ছিল এক। ¯œাতকোত্তর ডিগ্রি শেষ করলেই মেহেদীর কানাডা যাওয়ার স্বপ্ন পূরণ হবে। সেই স্বপ্ন বুকে লালন করে এক এক করে দিন কাটছিল মেহেদীর। কিন্তু এ স্বপ্ন যে স্বপ্নই রয়ে যাবে যেমন ভাবেননি মেহেদী, তেমনি তার পরিবারের সদস্যরা। হঠাৎ করে পুলিশের কাছ থেকে আসা একটি ফোন যেন নিস্তব্ধ করে দেয় পুরো পরিবারকে। কারণ ফোনের ওপাশ থেকে জানানো হয়, তাদের একমাত্র আদুরে মেহেদীর লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজের পুরাতন লাশঘরে, যা শোনার পর কান্নার শব্দে ভারী হয়ে ওঠে চট্টগ্রাম নগরীর আকবর শাহ এলাকার ফিরোজ শাহ কলোনির সি ব্লকের নীল রঙের ছয়তলা বাড়িটি। চাকরির ইন্টারভিউর জন্য ঢাকা যাওয়ার কথা বলে ১০ অক্টোবর শনিবার বিকাল ৫টার বাসে চট্টগ্রাম থেকে রওনা হন মেহেদী। ঢাকায় তাদের আত্মীয়স্বজনের বাসা থাকলেও তিনি খিলক্ষেতে বন্ধু আহসানের বাসায় ওঠেন। রাতে সেখানে পৌঁছে চট্টগ্রামে বাসায়ও যোগাযোগ করেন। পরদিন রবিবার সকালে বন্ধু আহসান চট্টগ্রামে মেহেদীর দুলাভাইকে কল দিয়ে জানান, বাসা থেকে বের হয়ে কোথায় গেছে মেহেদী খোঁজ পাচ্ছেন না। এটা জানার পর দুলাভাই মেহেদীর মোবাইল ফোনে কল দিলেও সংযোগ পাননি। পরে তারা খবর পান, হাতিরঝিল থেকে বস্তাবন্দী লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। সেটি ছিল মেহেদীর।

যেভাবে খুনি গ্রেফতার : হাতিরঝিল থেকে লাশ উদ্ধারের পর যে নম্বরটি খুঁজে পায়, তার খোঁজখবর নিতে শুরু করে পুলিশ। ফোনের সিমকার্ডটি পুলিশের কাছে প্রধান সূত্র হয়ে দাঁড়ায়। লোকেশন ট্র্যাকিং করে পুলিশ জানতে পারে, এর সর্বশেষ অবস্থান ছিল রাজধানীর খিলক্ষেত থেকে হাতিরঝিল। পুলিশের সন্দেহ জোরালো হয়। সিমকার্ডটি হয়তো এ খুনের ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ওই সিম থেকে কয়েকটি নম্বরে কল করা হয়েছিল। সেগুলোর অবস্থানও জানতে পারে পুলিশ। পুলিশ নিশ্চিত হয় নম্বরটি মেহেদীর। গ্রেফতার অভিযান চালায় পুলিশ।

এডিসি হাফিজ আল ফারুকের নেতৃত্বে একটি টিম ১৩ অক্টোবর দিবাগত রাত ১টা ২০ মিনিট থেকে ভোর ৬টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত খিলক্ষেত উত্তরপাড়া এলাকা থেকে এ হত্যাকান্ডে জড়িত আসামি আহসান ও তামিম, হাতিরঝিল থানাধীন মহানগর আবাসিক এলাকা থেকে আলাউদ্দিন এবং রামপুরা এলাকা থেকে রহিমকে গ্রেফতার করে। তারা ফাঁস করে পুরো খুনের ঘটনাটি। গ্রেফতার আহসান, আলাউদ্দিন ও রহিম পরে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

আহসানের জন্ম চট্টগ্রামে। তিনি মেহেদীর বাল্যবন্ধু। পাঁচ বছর মালেশিয়ায় থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশে ফেরেন আহসান। মার্চে ঢাকার গুলশান-২-এ অবস্থিত ‘দ্য গ্রোভ’ রেস্টুরেন্টে মাসিক ৬৫ হাজার টাকা বেতনে এক্সিকিউটিভ শেফ হিসেবে যোগদান করেন। তবে করোনায় রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আর্থিক সংকটে পড়েন আহসান। তখন তিনি তার স্ত্রীর আত্মীয় এ হত্যাকান্ডে জড়িত আলাউদ্দিনের কাছে কিছু টাকা ধার চান।

আলাউদ্দিন পেশায় ড্রাইভার হলেও পাসপোর্ট অফিসে দালালি ও পরিবহন পুলের পুরনো গাড়ি ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আহসানকে আলাউদ্দিন টাকা ধার না দিয়ে পাসপোর্ট-সংক্রান্ত কাজ (নামের বানান সংশোধন, জন্মতারিখ সংশোধন, বয়স বাড়ানো-কমানো) দিতে বলেন। এ কাজে যে টাকা পাওয়া যাবে তা দুজনে ভাগ করে নেবেন। আহসান বাল্যবন্ধু মেহেদীকে জানান, পাসপোর্টে সমস্যা-সংক্রান্ত কোনো কাজ থাকলে তিনি সমাধান করে দিতে পারবেন।

চট্টগ্রামের তিনটি পাসপোর্টের নাম ও বয়স সংশোধনের জন্য ১২ আগস্ট ঢাকায় আহসানের কাছে আসেন মেহেদী। আলাউদ্দিনকে মেহেদী এ বিষয়টি জানালে আলাউদ্দিন তার গাড়িতে করে আহসান ও মেহেদীকে মহানগর আবাসিক এলাকায় অবস্থিত তার বাসায় নিয়ে যান। দুই সপ্তাহের মধ্যে পাসপোর্ট তিনটির নাম ও বয়স সংশোধন করে দেওয়ার শর্তে আলাউদ্দিনকে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা ও আহসানকে ১ লাখ টাকা দেন মেহেদী। পাসপোর্ট তিনটি সংশোধনের জন্য দিলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ করে দিতে পারেননি আলাউদ্দিন। আহসান ও আলাউদ্দিনকে এ জন্য চাপ দেন মেহেদী। মেহেদীকে হত্যা করবেন বলে পরিকল্পনা করেন আহসান ও আলাউদ্দিন। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আহসান ও আলাউদ্দিন পাসপোর্ট নেওয়ার জন্য মেহেদীকে ১০ অক্টোবর ঢাকায় আসতে বলেন। এর পরই তারা পরিকল্পনামতো খুন করেন মেহেদীকে।

যেভাবে খুন : ১০ অক্টোবর, ২০২০। রাত ১১টা ১০ মিনিটে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে পৌঁছান মেহেদী। পরিকল্পনামতো মেহেদীকে খিলক্ষেত উত্তরপাড়ায় অবস্থিত তার ভাড়া বাসায় নিয়ে যান আহসান। খাবারের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয় মেহেদীকে। রাত আনুমানিক ১টা ৩০ মিনিটে ঘুমন্ত মেহেদীকে শ্বাসরোধে হত্যা করে হাত-পা রশি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে বেডশিট, মশারি ও পলিথিনে মুড়িয়ে মোবাইল ফোনে হত্যার পর বিষয়টি আলাউদ্দিনকে কনফার্ম করেন আহসান। এর আগেই ৮ অক্টোবর আলাউদ্দিন পেশাগত কাজে সিলেটে যান। নিজেকে সন্দেহের বাইরে রাখতে ঢাকার বাইরে অবস্থানকালে হত্যার পরিকল্পনা করে আহসানের মাধ্যমে মেহেদীকে ঢাকায় আসতে বলেন আলাউদ্দিন। পাশের কক্ষের ভাড়াটিয়া সহকর্মী তামিম আকস্মিকভাবে আহসানের কক্ষে ঢুকে হত্যাকান্ডের বিষয়টি জানতে পারেন। আহসানের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে তামিম জানান, বিষয়টি তিনি কাউকে বলবেন না এবং লাশটি সুবিধাজনক স্থানে ফেলে দিতে আহসানকে সহায়তা করবেন। লাশ সরিয়ে ফেলার জন্য ভোর ৪টার দিকে আলাউদ্দিন খিলক্ষেত উত্তরপাড়ায় আহসানের বাসায় গাড়ি পাঠান। ড্রাইভারকে গাড়িতে বসতে বলে আহসান ও তামিম নিজেরাই মালামাল গাড়িতে তুলবেন বলে জানান। এতে তাদের মালামাল গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান ড্রাইভার। পাশাপাশি ফজরের নামাজ শেষ হওয়ায় লোকসমাগম বেড়ে যাওয়ায় গাড়ি ছেড়ে দেন আহসান। এ অবস্থায় লাশ বিছানার নিচে রেখে বেলা ১২টার দিকে ‘দ্য গ্রোভ’ রেস্টুরেন্টে ডিউটিতে যান আহসান ও তামিম। কাজ শেষে দুজন একসঙ্গে বাসায় ফেরেন। রাত ১টার দিকে আলাউদ্দিনের নির্দেশে মাইক্রোবাসটি চালিয়ে লাশ ফেলে দেওয়ার জন্য খিলক্ষেত উত্তরপাড়ায় আহসানের বাসায় যান ড্রাইভার রহিম।

আহসান ও তামিম বিছানা, মশারি, বেডশিট ও পলিথিনে মোড়ানো  মেহেদীর লাশটি মাইক্রোবাসে উঠিয়ে ড্রাইভার রহিমকে সায়েদাবাদে যেতে বলেন। পথে তামিম নেমে যান। আহসান মাইক্রোতে লাশটি নিয়ে হাতিরঝিল এলাকায় প্রবেশ করেন। হাতিরঝিল লেকের মেরুল বাড্ডা প্রান্তে জনমানবশূন্য অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গা দেখে ড্রাইভার রহিম গাড়ি থামিয়ে দরজা খুলে দেন। আহসান লাশটি গাড়ি থেকে পানিতে ফেলে দেন। গ্রেফতার আসামিদের কাছে তিনটি পাসপোর্ট, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসার জন্য ব্যবহৃত মেহেদীর বাসের টিকিট জব্দ করা হয়েছে। পাশাপাশি যে মাইক্রোবাসটি ব্যবহার করে মেহেদীর লাশ হাতিরঝিলে ফেলে দেওয়া হয়েছে, সেটিও জব্দ করা হয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর