বুধবার, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

দখলমুক্ত নদীতীর

৭২৭ একর উদ্ধার, বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারপাশে উদ্ধার ৫০৫ একর, ২০ হাজার স্থাপনা উচ্ছেদ, বর্জ্য অপসারণ ৫০০ টন, নিলাম ও জরিমানা ১৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকা, আজ থেকে আবারও অভিযান

মাহমুদ আজহার ও রফিকুল ইসলাম রনি

দখলমুক্ত নদীতীর

দেশের নদ-নদীর সুরক্ষা, অবৈধ দখল থেকে নদীতীরের জমি উদ্ধারসহ স্থাপনা উচ্ছেদ, বর্জ্য অপসারণে ১০ বছর ধরে দেশব্যাপী ব্যাপকভিত্তিক অভিযান চলছে। এ সময়ে অবৈধ দখলদারের হাত থেকে উদ্ধার করা হয়েছে প্রায় ৭২৭.৮২ একর জমি। এর মধ্যে বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারপাশেই উদ্ধার করা হয়েছে ৫০৫.৪২ একর জমি। উচ্ছেদ করা হয়েছে ২০ হাজার ২৬৮টি অবৈধ স্থাপনা। বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে ৫০০ টন। ১ লাখ ঘনফুট বালু উত্তোলন করা হয়েছে। এসব তৎপরতার ফলে প্রাণ ফিরতে শুরু করেছে দেশের নদ-নদীগুলোতে। নদীর প্রবাহ ফিরিয়ে আনার জোর চেষ্টা চলছে। এদিকে আজ থেকে নতুন করে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হচ্ছে। ঢাকার সোয়ারীঘাট এলাকায় আজ  সকালে বিআইডব্লিউটিএ এই উচ্ছেদ অভিযান শুরু করবে।

২০১০ সাল থেকে চলতি মাস পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালিয়ে এই বিপুল পরিমাণ জমি উদ্ধার করা হয়েছে। এ সময় নিলাম ও জরিমানা করা হয়েছে ১৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। মামলাও হয়েছে অসংখ্য। বিভিন্ন মেয়াদে সাজাও দেওয়া হয়েছে ১২ জনকে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্রমতে, জেলা প্রশাসনের সহায়তায় ২০১৯ সালে দেশের বিভিন্ন নদীর ৫৭ হাজার ৩৯০ জন অবৈধ দখলদারকে চিহ্নিত করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। ওই নদীগুলো দখলমুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। একই সঙ্গে দখলদার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চিঠি দেওয়া হয়। বিশেষ করে ঢাকার প্রাণকেন্দ্র বুড়িগঙ্গাকে দখলমুক্ত করতে গত বছরের ২৯ জানুয়ারি থেকে শুরু হয় সাঁড়াশি অভিযান। টানা ৬ মাসে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় প্রায় সাড়ে ৬ হাজার অবৈধ স্থাপনা। উদ্ধার করা হয় অবৈধ দখলে থাকা জমিগুলো। দীর্ঘদিন বিরতি দিয়ে আজ থেকে আবার নদীকে অবৈধ দখলমুক্ত করতে অভিযান শুরু হচ্ছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধিভুক্ত অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) পৃথকভাবে এই অভিযান পরিচালনা করবে বলে জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে গতকাল নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দায়িত্ব গ্রহণের পর বুড়িগঙ্গাসহ বেশ কিছু নদী অবৈধ দখলমুক্ত করতে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছি। এক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দেওয়া হয়নি। যেসব নদী ও নদীর পাড় দখলমুক্ত করা হয়েছে, সেগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কয়েকটি প্যাকেজ টেন্ডার হয়েছে। আরও কিছু প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। বিআইডব্লিউটিএ প্রায় ৮২ শতাংশ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেছে। উচ্ছেদ অভিযান আমাদের চলমান প্রক্রিয়া। নদীকে দখলমুক্ত করে নদীর স্বাভাবিক গতি প্রবাহ ফিরিয়ে আনাই আমাদের মূল দায়িত্ব।

জানা গেছে, সারা দেশে মোট অবৈধ দখলদারের মধ্যে ঢাকাতেই সবচেয়ে বেশি। ঢাকায় এ পর্যন্ত উচ্ছেদ করা হয়েছে ১৫ হাজার ৪৭১টি অবৈধ স্থাপনা। জমি উদ্ধার করা হয়েছে ৫০৫.৪২ একর। এ ছাড়াও নদীর দুই পাড় থেকে ৫০০ টন বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে। এরপর উচ্ছেদ করা হয়েছে নারায়ণগঞ্জে। সেখানে ২০,১৫৯টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ এবং ৭২৬.১৭ একর জমি উদ্ধার করা হয়েছে। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের পাশাপাশি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ ও যশোরের নওয়াপাড়ায়ও নদীর জমি উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে আশুগঞ্জে ১ একর জমি উদ্ধারের পাশাপাশি ৫০টি স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। নওয়াপাড়ায় ৬৫ শতাংশ জমির পাশাপাশি ৫৯টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। 

নৌপরিবহন ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি উচ্ছেদ করা হয়েছে রাজধানীর চারপাশে তুরাগ ও বুড়িগঙ্গা নদীতীরে। এরই মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের দুজন সংসদ সদস্যের অবৈধ দখলে থাকা স্থাপনাও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করার পর নদীর সীমানা চিহ্নিত করে পিলার স্থাপনের কাজ চলছে। এদিকে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রাথমিকভাবে সারা দেশে ৪৫,০৯৫টি অবৈধ স্থাপনার তালিকা নিয়ে উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু হয়। ইতিমধ্যে উচ্ছেদ অভিযানে ৫২.৭৮ শতাংশ অগ্রগতি লাভ করে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। পুনরায় অবশিষ্ট ২১ হাজার ২৯৩টি স্থাপনা দখলমুক্ত করতে উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে মন্ত্রণালয়। উচ্ছেদকৃত জায়গায় এলাকা ও পরিবেশ উপযোগী বৃক্ষরোপণ করা হবে। সে লক্ষ্যে গত সোমবার মন্ত্রণালয়স্থ অফিস কক্ষে ৬৪ জেলা প্রশাসন ও সব বিভাগীয় কমিশনারদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে নানা দিকনির্দেশনা দেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার। এ সময় তিনি বলেন, আমরা বিভিন্ন পর্যায়ে তালিকা করে ২৩,৮০২টি স্থাপনা উচ্ছেদ করেছি। আমাদের উদ্ধারকৃত জমির পরিমাণ ১০২৭ একর জমি। কিন্তু করোনায় উচ্ছেদ কার্যক্রম ধীরগতি পায়। অতি শিগগিরই আমরা আবার তা শুরু করতে যাচ্ছি। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ আমাদের চলমান প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। যত বড় প্রভাবশালীই হোক পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জায়গা দখল করতে দেওয়া হবে না। উচ্ছেদ করে দখলমুক্ত করা হবেই।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র আরও জানায়, ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ঢাকার চারদিকে নদীর তীরভূমিতে ২০০০টি স্থায়ী এবং টেকসই সীমানা পিলার নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়াও প্রায় ২৩.৫ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। ঢাকার শ্যামপুর এবং খানপুরে ২টি ইকোপার্ক নির্মাণ করা হয়েছে। ঢাকার চারপাশের নদীগুলো সচল রাখতে একটি মাস্টারপ্ল্যান করা হয়েছে। সেই অনুযায়ী কাজও শুরু হয়েছে। বিআইডব্লিউটিএর (বন্দর ও পরিবহন) পরিচালক কাজী ওয়াকিল নেওয়াজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নদীর জায়গাকে নদীকে ফিরিয়ে দেওয়াই আমাদের লক্ষ্য। এজন্যই আমাদের অবৈধ উদ্ধার অভিযান চলছে। নদী যেন নিজের গতি প্রবাহে চলে সেটাই লক্ষ্য। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন নদীগুলো সংরক্ষণে রাখে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর