শনিবার, ৬ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

করোনায় টেলিমেডিসিনের বিস্ময়কর প্রসার!

প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসে মিলছে ঢাকার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ। বিভিন্ন হাসপাতাল-ক্লিনিক ছাড়াও অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠান দিচ্ছে টেলিমেডিসিন সেবা

নিজস্ব প্রতিবেদক

করোনায় টেলিমেডিসিনের বিস্ময়কর প্রসার!

করোনাভাইরাস মহামারীতে চিকিৎসা ব্যবস্থার চরম সংকটের মধ্যে দ্রুত প্রসার পাচ্ছে টেলিমেডিসিন সেবা। প্রতিদিনই এই সেবায় যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও চিকিৎসক। তথ্য-প্রযুক্তির সুবিধা ব্যবহার করে প্রত্যন্ত গ্রামে বসেও ভিডিও কলে বা তৃতীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের অ্যাপের মাধ্যমে নেওয়া যাচ্ছে ঢাকার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ। দেখানো যাচ্ছে ডায়াগনস্টিক রিপোর্ট। প্রযুক্তির মাধ্যমে দূর থেকেই চিকিৎসক মাপতে পারছেন রোগীর শরীরের তাপমাত্রা, হৃদস্পন্দন বা ফুসফুসের শব্দ। পুরোপুরি প্রাতিষ্ঠানিকতা না পেলেও ক্রমেই বড় হচ্ছে টেলিমেডিসিন বাজার। গত বছরের মার্চে দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হলে ভেঙে পড়ে চিকিৎসা ব্যবস্থা। একদিকে হাসপাতালে যেতে সংক্রমণ আতঙ্ক, অন্যদিকে চিকিৎসা পেতে করোনা নেগেটিভ সনদ দেখানোর বিধি চালু করে অনেক হাসপাতাল, ক্লিনিক। এতে ভোগান্তিতে পড়েন সব ধরনের রোগী। চিকিৎসা সংকটে পড়েন অন্তঃসত্ত্বা নারী, ডায়াবেটিস, কিডনি বা হৃদরোগীর মতো নিয়মিত চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকা মানুষগুলো। ঠিক তখনই যেন অন্ধকার টানেলের অপর প্রান্তে আলোর বিন্দু হয়ে সামনে আসে টেলিমেডিসিন সেবা। নতুন নতুন প্রতিষ্ঠানের আত্মপ্রকাশ ঘটে টেলিমেডিসিন সেবায়। অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের ফেসবুক মেসেঞ্জারে চ্যাটিংয়ের মাধ্যমে ডাক্তারের পরামর্শ পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, ভাইবার, স্কাইপ ব্যবহার করে রোগী দেখছেন চিকিৎসকরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন রোগভিত্তিক চিকিৎসককে যুক্ত করে টেলিমেডিসিন সেবা দিচ্ছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত আছে ১ হাজার ২০০-এর বেশি চিকিৎসক। চর্ম ও যৌন রোগ, প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ, পরিপাকতন্ত্র-লিভার ও অগ্নাশয় রোগ, নবজাতক ও শিশু-কিশোর রোগ, কিডনি মূত্রনালির রোগ, মানসিক রোগসহ সব ধরনের রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ পাওয়া যাচ্ছে সশরীরে উপস্থিত না হয়ে। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট দেখে অনলাইনেই ব্যবস্থাপত্র পাঠিয়ে দিচ্ছেন চিকিৎসক। প্রয়োজন মনে হলে রোগীকে হাসপাতালে যাওয়ার বা ভর্তির পরামর্শ দিচ্ছেন। এতে সাধারণ রোগীদের ভোগান্তি কমার পাশাপাশি হাসপাতালের ওপর চাপ কমছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিক্যাল ফিজিক্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের উদ্যোগে ২০১৫ সালে টেলিমেডিসিন সেবা চালু হয়। শুধু ভিডিও কল নয়, নিজস্ব উদ্ভাবিত প্রযুক্তির মাধ্যমে দূর থেকে রোগীর ইসিজি, হৃদস্পন্দন, ফুসফুরের শব্দ, শরীরের তাপমাত্রা পরিমাপেরও ব্যবস্থা করে প্রতিষ্ঠানটি। ঢাবি’র টেলিমেডিসিন কার্যক্রমের সমন্বয়ক এম এ ইউসুফ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বর্তমানে সারা দেশে আমাদের ৫০টির বেশি টেলিমেডিসিন সেন্টার আছে। এ পর্যন্ত ৩৩ হাজারের বেশি রোগীকে সেবা দেওয়া হয়েছে। মাত্র ১৫০ টাকা দিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া একটি হটলাইন নম্বর চালু করে বিনামূল্যে করোনা বিষয়ক পরামর্শ দিচ্ছি। তবে, অর্থাভাবে আমাদের ‘টেলি আপা’ সেবাটি এখন বন্ধ আছে। আগামী মার্চে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এলজিএসপি-৩ প্রকল্পের অর্থায়নে ঢাকার ১০টি ইউনিয়নে টেলিসেন্টার চালু করার কথা রয়েছে। ওই প্রকল্পে আমরা কারিগরি সহায়তা দেব। আশা করছি, নামমাত্র ফি দিয়ে রোগীরা ভালো স্বাস্থ্যসেবা পাবে।

এ ছাড়া সরকারের স্বাস্থ্য বাতায়ন ১৬২৬৩, জাতীয় হেল্পলাইন ৩৩৩-১ ও আইইডিসিআর’র হটলাইন ১০৬৫৫ থেকে দেশে করোনার প্রকোপের শুরু থেকে গত ২ মার্চ পর্যন্ত ২ কোটি ৩৭ লাখ ৬৪ হাজার ৭৬৫ জনকে টেলিফোনে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া করোনাকালে মা ও শিশুদের ঘরে বসে চিকিৎসা সেবা দিতে সরকার চালু করেছে মা টেলিহেলথ (০৯৬৬৬৮৮৮৮৮৮)। চালু করা হয়েছে কভিড-১৯ টেলিহেলথ (০৯৬৬৬৭৭৭২২২)। এ ছাড়া লাইফস্প্রিং, অর্ক হেলথ লিমিটেড, সিনেসিস হেলথ, ডিজিটাল হেলথ, প্রাভাহেলথ, প্রবাসী হেল্পলাইন, হিউম্যান হেলথ হেল্পলাইন, ডিজিটাল হেলথকেয়ার ফাউন্ডেশন, কুইকমেড, জীয়ন, বেস্ট এইড, মায়া, ডাক্তার দেখাও, ডক্টরোলা, মনের বন্ধু, ক্লিক এন কেয়ার, যত্ন, আস্ক ডক্টর, মেডিসিন ক্লাব, ডাক্তার বাড়িসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান টেলিমেডিসিন সেবা দিচ্ছে। বিভিন্ন মোবাইল অপারেটরও তাদের গ্রাহকদের জন্য চালু করেছে টেলিমেডিসিন সেবা। রবি ও এয়ারটেল গ্রাহকদের জন্য যেমন রয়েছে ‘হেলথ প্লাস’, বাংলালিংক গ্রাহকদের জন্য রয়েছে ‘ডাক্তারভাই’, গ্রামীণফোন গ্রাহকদের জন্য রয়েছে ‘টনিক’। এ ছাড়া স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, ১০টি বিশেষায়িত হাসপাতাল, আটটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ১১টি জেলা হাসপাতাল ও ৬৫টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে টেলিমেডিসিন সেবা চালু করা হয়েছে। চিকিৎসার ক্ষেত্রে কিছু প্রতিষ্ঠান চিকিৎসকের ধরন ভেদে ১০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত ফি রাখছে। কিছু প্রতিষ্ঠান অ্যাপে প্যাকেজভিত্তিক সাবক্রিপশন চার্জ নিয়ে চিকিৎসা পরামর্শ দিচ্ছে।

তবে টেলিমেডিসিনে আছে হয়রানির অভিযোগও। অধিকাংশ জেলা হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে টেলিমেডিসিন সেবা পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোন করেও চিকিৎসক না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ওয়েব ক্যাম ও ল্যাপটপ বিকল হয়ে বন্ধ রয়েছে অনেক সরকারি হাসপাতালের টেলিমেডিসিন কার্যক্রম। বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েও নির্ধারিত সময়ে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ না করিয়ে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে ভূরি ভূরি।

এসব বিষয়ে সফটওয়্যার ও তথ্য সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বেসিসের সহসভাপতি মুশফিকুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশে চিকিৎসক সংকট আছে। বিশেষায়িত চিকিৎসকরা আবার শহরকেন্দ্রিক। শহরে রয়েছে যানজট। ছোটখাটো অসুখগুলোর চিকিৎসা টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে দিতে পারলে খুবই ভালো হবে। তবে এটাকে আরও ফলপ্রসূ করতে একটা গাইডলাইন প্রয়োজন। অবশ্যই চিকিৎসককে নিবন্ধিত হতে হবে। রোগীর ইলেকট্রনিক হেলথ ডেটা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করলে চিকিৎসা অনেক সহজ হয়ে যাবে। সেই সঙ্গে চিকিৎসার তথ্যও থাকতে হবে। তবে স্পর্শকাতর হওয়ায় এই তথ্য কারা দেখতে পারবে তারও একটা পলিসি থাকা জরুরি।

সর্বশেষ খবর