মঙ্গলবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

হাতে জন্মদিনের কেক ব্যাক পকেটে হাতুড়ি

মির্জা মেহেদী তমাল

হাতে জন্মদিনের কেক ব্যাক পকেটে হাতুড়ি

কলিংবেলের শব্দে দরজা খুলে দেন সীতাংশু শেখর বিশ্বাস। দরজার সামনে দাঁড়ানো এক যুবক। এক হাতে জন্মদিনের কেক। আরেক হাতে জুস আর ফুল। স্যার, আপনার আজ জন্মদিন। আমার তরফ থেকে সামান্য কিছু উপহার। সীতাংশু শেখর বিশ্বাসের চোখে-মুখে লাজুক ভাবটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। হাত বাড়িয়ে ফুল কেক আর জুসের প্যাকেট নিতে নিতে বলেন, এই বয়সে আবার কিসের জন্মদিন! এসব আনতে গেলে কেন! এত সব দরকার কী ছিল? যুবকের জবাব, ‘হ্যাঁ বড় ভাই, খুব দরকার ছিল। আপনার জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে পারলে আমার খুব ভালো লাগবে।’ এ কথা বলতে বলতে ভিতরে ঢুকে সোফায় বসে যুবকটি। দুজনে কথা বলছেন। এক সময় একটা জুসের প্যাকেট বের করে যুবকটি। মুখ খুলে সীতাংশুর দিকে এগিয়ে দেয়। কিন্তু সীতাংশু তখন খেতে চান না। বলেন, ওটা এখন থাক। টেবিলে রেখে দাও। পরে খেয়ে নেব। কিন্তু নাছোড়! জুস সে খাওয়াবেই। তাও নিজের হাতে। বাধ্য হয়েই জুস খেলেন সীতাংশু। জুস খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাথাটা চক্কর দেয় তার। অচেতন হয়ে মেঝের ওপর পড়ে যান তিনি। এ সময় টেবিলের সঙ্গে ধাক্কা লাগলে বড় ধরনের শব্দ হয়। কিন্তু যুবকটি যেন এমন একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। সময় নষ্ট করল না। নিজের প্যান্টের ব্যাক পকেটে হাত দিল। সেখান থেকে লুকিয়ে রাখা মাঝারি আকারের হাতুড়িটা তুলে আনে। সেই হাতুড়ি দিয়ে সীতাংশুর মাথায় আঘাত করতে থাকে। গোঙ্গানির শব্দ বের হচ্ছে সীতাংশুর মুখ থেকে। শব্দ শুনে ভিতরের রুম থেকে ছুটে আসেন সীতাংশুর স্ত্রী কৃষ্ণা কাবেরী। তিনি যুবকটির ভয়ঙ্কর রূপ দেখে ভিতরে চলে যান। কয়েক মুহূর্ত পরেই ফিরে আসেন একটি বঁটি হাতে। স্বামীকে রক্ষার চেষ্টা প্রাণান্তকর। কিন্তু যুবকটি হাতুড়ি দিয়ে তাকেও আঘাত করে। ছিনিয়ে নেয় বঁটি। সেই বঁটি দিয়েই এবার আঘাতের পর আঘাত চলে কাবেরীর ওপর।

মা-বাবার চিৎকার শুনে ছুটে আসে তাদের আট বছরের শিশুকন্যা। তার মাথায়ও হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে। মা, বাবা আর বোনের এ দৃশ্য দেখে ভয়ে একটি কক্ষের ভিতর ঢুকে দরজা বন্ধ করে কাঁপতে থাকে স্কুলপড়ুয়া বড় মেয়েটি। কিন্তু ছোট বোনের আর্তচিৎকার সহ্য করতে পারেনি। হাতের কাছে ছিল ফুলের টব। সেটা নিয়েই বেরিয়ে আসে সে। উন্মত্ত যুবককে প্রতিহত করার চেষ্টা করে মেয়েটি, তবে পারেনি। উল্টো হাতুড়ির আঘাতে ছিটকে পড়ে মেঝেতে। বাবা-মা আর দুই মেয়ে তখন রক্তাক্ত। মেঝেতে কাতরাচ্ছে। মেঝে ভেসে যাচ্ছে রক্তে। আর সেই যুবক যেন রক্তের হোলি খেলায় মত্ত। ঘরের আলো নিভিয়ে দেয়। দেশলাই জ্বালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় ঘরে। সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে কাবেরীর কাপড়ে। দুই বোন রক্তাক্ত অবস্থায় তাদের মাকে বাঁচাতে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। এবার তাদের গগনবিদারি চিৎকার। বাঁচাও বাঁচাও। আগুন! চিৎকারে আশপাশের লোকজন ছুটে আসে। কিন্তু ততক্ষণে ভয়ঙ্কর সেই যুবক লাপাত্তা। আগুন নিভিয়ে হাসপাতালে নেওয়া হলো চারজনকেই। কিন্তু চিকিৎসকরা কৃষ্ণা কাবেরীকে মৃত ঘোষণা করেন। আর মৃত্যুর সঙ্গে লড়তে থাকে তার স্বামী ও দুই সন্তান। ঘটনাটি ঢাকার আদাবরের। ২০১৫ সালের পয়লা এপ্রিল রাতে এই ভয়ঙ্কর সময় নেমে এসেছিল সীতাংশু পরিবারে।

সীতাংশু শেখর বিশ্বাস বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) উপপরিচালক (ডিডি-প্রকৌশল)। আর কৃষ্ণা কাবেরী মোহাম্মদপুরের আদাবরের মিশন ইন্টারন্যাশনাল কলেজে শিক্ষকতা করতেন। মেয়ে শ্রুতি মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী। একই স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে অয়ত্রী। কৃষ্ণা কাবেরীর বাড়ি খুলনার ডুমুরিয়ায়। সীতাংশু বিশ্বাসের বাড়ি রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার মহরপুর গ্রামে।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের আদাবর ইকবাল রোডের ৩/১২ নম্বর ছয়তলা বাড়ির দ্বিতীয়তলার ১/ডি নম্বর ভাড়া ফ্ল্যাটে পরিবার নিয়ে থাকেন সীতাংশু।

সে রাতের ঘটনা শুনে ছুটে আসে পুলিশ, র‌্যাব আর গোয়েন্দারা। তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। তদন্ত শুরু করে। প্রথমেই গোয়েন্দারা বাড়ির দারোয়ানকে জেরা করে। জানতে পারে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।

গোয়েন্দারা জানতে পারে হামলাকারীর নাম জহিরুল। সে তাদের পূর্ব পরিচিত। আগেও এসেছে ওই বাসায়। দারোয়ান জানিয়েছেন, রাত ৯টায় যুবকটি এলে ইন্টারকমে সীতাংশুকে জানানো হয়। তিনি ওপরে পাঠিয়ে দিতে বলেন। রাত দশটায় চিৎকার শুরু হয় ওই ফ্ল্যাটে। গোয়েন্দারা জানতে পারে, জহিরুল গুলশানের হাজী আহমেদ সিকিউরিটিজ নামের একটি ব্রোকারেজ হাউসের ব্যবস্থাপক। শেয়ার ব্যবসায় বিনিয়োগ আছে সীতাংশুর। গোয়েন্দারা সন্দেহ করে ব্যবসায়িক কোনো দ্ধন্ধেই এই নৃশংসতা।

অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে ওঠেন সীতাংশু এবং তার দুই মেয়ে। গোয়েন্দারা সীতাংশুর কাছ থেকে জহিরুলের সম্পর্কে জানার চেষ্টা করে। জহির সম্পর্কে বিশদ তথ্য দেওয়া হলেও তার নাগাল খুঁজে পায় না গোয়েন্দারা। একাধিক টিম কাজ করলেও অধরা থাকে খুনি জহির। ঢাকা ছাড়াও গোয়েন্দারা দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালালেও খোঁজ পাওয়া যায় না জহিরের। দিন যায়, সপ্তাহ যায় মাস ঘুরে, জহির কোথাও নেই। তবে তাকে গ্রেফতারে সীমান্ত এলাকাগুলোতেও অ্যালার্ট থাকে পুলিশ। পুলিশের ধারণা, জহির দেশ ছেড়ে পালাতে পারেনি। তবে এমন নৃশংসতার পরও খুনি রক্ষা পেয়ে যাচ্ছে, সাধারণ মানুষের মনে ক্ষোভ হতে থাকে। হঠাৎ গোয়েন্দাদের কাছে খবর আসে জহিরুল আদালতে আত্মসমর্পণ করবে। ঘটনার প্রায় সাত মাস পর জহির আদালতে আত্মসমর্পণ করে। গোয়েন্দারা তাকে রিমান্ডে নেয়। দুই দফায় চার দিনের রিমান্ডে নিলেও প্রথম দফায় কোনো তথ্য দেয়নি জহির। পরের দফায় মুখ খুলে জহিরুল। গোয়েন্দা জিজ্ঞাসাবাদে বলেছে, নিজ হাতেই খুন করেছে বিআরটিএ কর্মকর্তা সীতাংশু শেখর বিশ্বাসের কলেজ শিক্ষিকা স্ত্রী কৃষ্ণা কাবেরীকে। টাকার জন্যই এ খুন বলে জানিয়েছে একমাত্র আসামি জহিরুল। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। জহিরুল বলেছে, ‘আমিই খুন করেছি কৃষ্ণা কাবেরীকে।’

ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বিবরণ দিয়েছে সীতাংশু শেখরের বাসায় সেই রাতের ঘটনাবলির। জহিরুল বলেছে, তার কিছু টাকার প্রয়োজন ছিল। ভেবেছিল, সীতাংশুর বাসায় সেই টাকা পাওয়া যাবে। এ জন্য সীতাংশুর জন্মদিনে তার জন্য কেক ও চেতনানাশক মেশানো জুস নিয়ে যায়। জুস খেয়ে বাসার সবাইকে অচেতন করে টাকা নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল তার। তবে জুস খেয়ে সীতাংশু কিছুটা অচেতন হলেও তার স্ত্রী বিষয়টি দেখে ফেলেন। তিনি চিৎকার দিলে ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে খুন করে পালিয়ে যায় জহিরুল। গোয়েন্দারা জানায়, জহিরুল ইসলাম পলাশের শেয়ার ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠানে ৮ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) উপ-পরিচালক সীতাংশু শেখর বিশ্বাস। সেই টাকা আত্মসাতের জন্যই কৌশলে বাসায় ঢুকে সবাইকে হত্যার চেষ্টা করেছিল জহিরুল।

বিচার : ২০১৯ সালের ৩ জানুয়ারি কৃষ্ণা কাবেরী হত্যা মামলায় এম জহিরুল ইসলাম পলাশকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছে আদালত। ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন এই রায় ঘোষণা করেন। তবে জহিরুল ইসলাম হাই কোর্ট থেকে জামিন নিয়ে পলাতক রয়েছেন। তাকে গ্রেফতারের জন্য পরোয়ানাও জারি করেছেন বিচারক।

সর্বশেষ খবর