শুক্রবার, ২১ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

লাশ দেখে আঁতকে ওঠেন কর্মকর্তারা

মির্জা মেহেদী তমাল

লাশ দেখে আঁতকে ওঠেন কর্মকর্তারা

তালা ভেঙে ঘরে ঢুকে লাশ দেখে আঁতকে ওঠেন পুলিশ কর্মকর্তারা। দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে। পুলিশ কর্মকর্তারা রুমালে নাক ঢেকে লাশের সামনে যান। লাশ যতই বীভৎস হোক না কেন, সুরতহাল রিপোর্ট করতে হবে। পচা বা গলা-যাই হোক না কেন উল্টে পাল্টে দেখতে হবে মৃতদেহ। তাদের তো এভাবেই গড়ে তোলা হয়েছে। মৃতদেহ ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন একজন কর্মকর্তা। যুবকটিকে জবাই করা হয়েছে। বুকের বাম পাশে বড় ধরনের কাটার দাগ। মৃতদেহের পাশে পড়ে আছে কলিজা। সেটিও দুই ভাগ করা! শুকিয়ে আছে রক্ত। চটচট করছে বিছানা।

পুলিশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করতে সকাল থেকে দুপুর লাগল পুলিশের। এরপর রুমের চারপাশ দেখে নিলেন। খুনের যোগসূত্র খুঁজতে থাকেন পুলিশের কর্মকর্তারা। কোমল পানীয়র একটি খালি বোতল, আর রক্ত মাখা একটি চাপাতি খুঁজে পায় পুলিশ। কিন্তু খুনি শনাক্তে তেমন কোনো সূত্র তার চোখে পড়ে না।

ঘটনাটি খুলনার। নগরীর জোড়াগেট আবাসিক এলাকার এসডি কলোনির একটি ভবনের নিচ তলা থেকে পচে যাওয়া লাশটি উদ্ধার করে পুলিশ। নাম তার ইমদাদুল হক শিপন। খানজাহান আলী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মহাবিদ্যালয়ের মেডিকেল ইনস্টিটিউটের প্যাথলজি বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন শিপন। ২০১৪ সালের ৯ মার্চ লাশটি উদ্ধার করে পুলিশ। ওই বাসাটি ছিল শিপনের মামা গণপূর্ত বিভাগের কর্মকর্তা আবু বক্করের। শিপন সেখানেই থাকত। আবু বক্কর পরিবার নিয়ে গ্রামের বাড়িতে যান ৬ মার্চ। শিপনের লাশ উদ্ধার হয় ৯ মার্চ। এ ঘটনায় শিপনের ভাই বাদী হয়ে সোনাডাঙ্গা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলা নং ৭। তাতে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করা হয়। শিপন হত্যা মামলার তদন্ত শুরু করে পুলিশ। পুলিশের এসআই শওকত হোসেন খুনের এই ঘটনাটি তদন্ত করতে যেয়ে কোনো কূলকিনারা খুঁজে পান না। তবে তিনি এটা নিশ্চিত যে, খুনটি কোনো সাধারণ মাপের খুনির কাজ নয়। পেশাদার খুনির কাজ। কিন্তু কলিজা বের করে আনার বিষয়টি নিয়েই পুলিশ ভাবছে বেশি। পেশাদার খুনির ধারণাটি সেখানে পাল্টে যাচ্ছে। কারণ পেশাদার খুনিদের কাজ খুন করা। কলিজা কেন বের করা হবে! এমন নানা প্রশ্ন ঘুরপাক পুলিশের মধ্যে। পুলিশ কর্মকর্তা তদন্ত করতে যেয়ে জানতে পারে ওই ভবনে এক তরুণীর প্রবেশ ঘটেছিল। যা স্থানীয় ২/১ জন দেখেছেন। পুলিশ সেই লোকজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করে মেয়েটির নাম পরিচয় জানতে পারে। তাকে ধরতে প্রথমে পুলিশ গ্রেফতার করে অনিক নামে এক যুবককে। অনিকের মাধ্যমেই ধরা পরে সোনালী নামের এক তরুণী। পুলিশের জেরার মুখে পড়ে সোনালী। একপর্যায়ে পুলিশের জেরায় সেই সোনালী সব ফাঁস করে। স্বীকার করে নেয়, খুনের দায়। পুলিশ জানতে পারে, পেশাদার খুনি নয়, খুন করেছে এক নারী। শিপনের প্রেমিকা সেনালী। তদন্ত সূত্র জানায়, সোনাডাঙ্গা থানার গণপূর্ত বিভাগের আবাসিক কলোনিতে মামা আবু বক্করের বাসায় থেকে নগরীর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মহাবিদ্যালয়ের মেডিকেল ইনস্টিটিউট বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র হিসেবে লেখাপড়া করতেন শিপন। পাশাপাশি সে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে লিফট অপারেটরের দায়িত্ব পালন করতেন। ২০১৩ সালে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সোনালীর সঙ্গে শিপনের পরিচয় এবং প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়।

সোনালী পুলিশকে বলে, শিপনকে ভালোবাসতাম অনেক। এক সময় জানতে পারি এবং শিপনের ল্যাপটপে দেখতে পাই তার সাথে আরও ৪/৫ জন মেয়ের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক আছে। এ ঘটনায় আমি দারুণভাবে ক্ষুব্ধ হই এবং শিপনকে হত্যার পরিকল্পনা আঁটি। ওর কলিজা কত বড় হয়েছে, তা দেখতে চাই।

সোনালী বলে যায়, শিপনের মামা মাগুরায় গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যান। ওই সুযোগে আমি ৮ মার্চ শিপনের বাসায় যাই। যাওয়ার সময় ২০টি ঘুমের বড়ি গুঁড়ো করে কোমল পানীয়ের সঙ্গে মেশাই। সেটা হাতে করে নিয়ে যাই। রাতেই শিপনকে খাইয়ে দেই। শিপন অচেতন হয়ে পড়ে। তার হাত-পা বেঁধে ফেলি। প্রথমে গলা কাটি। হত্যার পর শিপনের বুক কেটে কলিজা বের করি দেখি। কিন্তু তেমন কোনো বড় নয় বলে, ওটাও দুই ভাগ করি। তা লাশের পাশে ফেলে রেখে ল্যাপটপ ও মোবাইল নিয়ে পালিয়ে যাই। এসব পুরো ঘটনা আদালতে স্বীকারোক্তিতেও বলেছে সোনালী।

বিচারিক আদালত সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করে আদালত সোনালীকে রশিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকরের নির্দেশ দিয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় মেহেদী হাসান অনিককে বেকসুর খালাস প্রদান করা হয়। ২০১৭ সালের ২৮ মার্চ এ রায় ঘোষণা করা হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর