শুক্রবার, ৪ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

৫০০ টিকটকার চিহ্নিত

আলী আজম

কুরুচিপূর্ণ ভিডিও বানিয়ে অশ্লীলতা ছড়ানো, নারী পাচার, গ্যাং তৈরির সঙ্গে জড়িত ৫০০ টিকটকার চিহ্নিত করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তাদের ধরতে ইতিমধ্যে অভিযান শুরু হয়েছে। গ্রেফতারও হয়েছে বেশ কয়েকজন। টিকটকের আড়ালে টিকটকারদের অপকর্ম ফাঁস হতে থাকায় পুলিশ টিকটকদের বিরুদ্ধে এ অভিযান শুরু হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে। সূত্র জানায়, সম্প্রতি ভারতের বেঙ্গালুরুতে বাংলাদেশি এক তরুণীকে যৌন নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর টিকটক হৃদয় বাবুসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করে ভারতীয় পুলিশ। এরপরই নড়েচড়ে বসে বাংলাদেশ পুলিশ। বাড়ানো হয় সাইবার নজরদারি। ভাইরাল হওয়া ভিডিও ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে আন্তর্জাতিক নারী পাচার চক্রের তথ্যও বেরিয়ে আসে। এই চক্রের অন্যতম মূল হোতা আশরাফুল মন্ডল ওরফে বস রাফিসহ ইতিমধ্যে সাতজনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব ও পুলিশ। এই চক্র ইতিমধ্যে দেড় হাজার নারীকে ভারতে পাচার করেছে। পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) মো. সোহেল রানা বলেন, টিকটকসহ এ ধরনের যে কোনো প্ল্যাটফরমে আইনবিরোধী যে কোনো প্রকার কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত থাকলে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। অপরাধ করলে আইনি ব্যবস্থার পাশাপাশি কিশোর-কিশোরী ও উঠতি বয়সের ছেলে মেয়েদের সুশীল ও ইতিবাচক কাজে নিয়োজিত রাখার জন্য পিতা-মাতা, শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট অন্যদেরও উদ্যোগী হতে হবে। জানা গেছে, ইন্টারনেটে টিকটক অ্যাপস ব্যবহার করে ছোট ছোট অভিনয়ের ভিডিও তৈরির মাধ্যমে হাজার হাজার লাইক সংগ্রহের বিপরীতে রাতারাতি সেলিব্রেটি হওয়ার নেশায় আটকে পড়েছে হাজারো কিশোরী-তরুণী। শুরুতে অভিভাবকদের ফাঁকি দিয়ে টিকটক স্টাইলের ভিডিওতে অভিনয় করাকালেই বেশির ভাগ মেয়ে নানা রকম প্রতারণার ফাঁদে পড়ে। প্রথমদিকে সেসব ভিডিওর নির্মাতারাই অবুঝ কিশোরীদের নানা ফাঁদে ফেলে যৌন হয়রানি চালায় এবং সেসব নগ্ন দৃশ্য গোপন ভিডিও ক্যামেরায় ধারণ করে তা স্টক হিসেবে বিভিন্ন মেমোরি কার্ডে সংরক্ষণ করে থাকে। প্রতারকদের ভাষায় এসব স্টক শটকে ‘কট শট’ হিসেবেও প্রচার করে থাকে। এ কট শট একবার ভুক্তভোগী মেয়েকে দেখানোর পর থেকেই সে পুরোপুরি জিম্মি হয়ে পড়ে। তখন ভিডিও নির্মাতাদের আদেশ-নির্দেশের ক্রীড়নক হতে বাধ্য হয় তারা।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা যায়, একেকজন ভিডিও নির্মাতার কাছে এক-দেড় শ মেয়ের নগ্ন দৃশ্য-সংবলিত ভিডিওচিত্র স্টক হিসেবে রাখার এন্তার নজির রয়েছে। টিকটকের কারণে অল্প সময়ে অনলাইন তারকা বনে যাচ্ছে অসংখ্য কিশোর। জনপ্রিয়তা পাওয়া টিকটকারদের বেশির ভাগের বয়স ২০ থেকে ২৫ বছর। তাদের ফলোয়ার সংখ্যা লাখ লাখ। অনেকের এর থেকেও বেশি। পর্যালোচনায় দেখা যায়, বাংলাদেশে জনপ্রিয় টিকটকারদের বেশির ভাগই অশিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিত। কেউ সেলুনে কাজ করে, কেউ দিনমজুরের কাজ করে। কেউবা কোনো দোকানের বিক্রয়কর্মী। এর বাইরে স্কুল, কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা টিকটকে নিজেদের বিলিয়ে দিচ্ছে। পুলিশ জানায়, টিকটকের সূত্র ধরে তারকা হওয়ার নেশায় বিভোর কিশোররা জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধে।

 জনপ্রিয়তার নিরিখে তৈরি হয় এলাকাভিত্তিক গ্যাং। এই গ্যাং খোলা জায়গায়, ফুটপাথে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে একত্র হয়ে ভিডিও কন্টেন্ট তৈরির নামে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, ইভ টিজিং, পথচারীদের গতিরোধ, বাইক মহড়াসহ বিভিন্ন অসৌজন্যমূলক আচরণ করে থাকে। এমনকি কবরস্থানের মতো স্পর্শকাতর জায়গায় টিকটক করতে এরা পিছপা হয় না। রাজধানীর রায়েরবাজারে অবস্থিত বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে গেলে এসব চিত্র অহরহ চোখে পড়ে। কখনো কখনো এক এলাকার গ্যাংয়ের সঙ্গে অন্য এলাকার গ্যাংরা বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। অনেক সময় ঠুনকো বিষয়কে কেন্দ্র করে খুনের মতো ঘটনা ঘটে যায়। টিকটকে তারকা বনে যাওয়া কিশোরদের প্রতি তরুণীদের একধরনের আগ্রহ তৈরি হয়। সেই আগ্রহ থেকে তারা কিশোরদের সঙ্গে দলবদ্ধ হয়ে বিভিন্ন জায়গায় টিকটক করতে চলে যায়। এই সুযোগ নেয় কিশোর গ্যাং। তাদের ফাঁদে ফেলে ধর্ষণ, নারী পাচারের মতো জঘন্য কাজ করে থাকে।

সম্প্রতি বাংলাদেশি এক তরুণীকে ভারতের কেরালায় নিয়ে যৌন নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর সামনে বেরিয়ে আসছে মানব পাচারের মতো চাঞ্চল্যকর তথ্য। টিকটকের আড়ালে মানব পাচার করছে এমন কয়েকটি চক্রের সন্ধান পেয়েছে পুলিশ। একাধিক টিকটক গ্রুপের সদস্যরা আন্তর্জাতিক নারী পাচার চক্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে জানায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া মাত্র ৩০ হাজার টাকায় পাচার করা হয় তরুণীদের। গত পাঁচ বছর ধরে তারা এই কাজ করে আসছে। বাংলাদেশি তরুণীদের বিদেশে ভালো চাকরি ও টিকটকের নায়িকা তৈরির প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করা হয়েছিল। এই চক্রের অন্যতম হোতাসহ কয়েকজন পুলিশের গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছে। যে কোনো সময় তারা গ্রেফতার হতে পারে বলে জানা গেছে। রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ (আরএমপি) কমিশনার মো. আবু কালাম সিদ্দিক জানান, সাম্প্রতিক সময়ে কিছু যুবক ছেলে-মেয়ে বিভিন্ন টিকটক ভিডিও বানিয়ে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের আসক্ত করছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ১ জুন রাজশাহীতে অভিযান চালিয়ে ৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এদের মধ্যে তিনজন মেয়ে এবং ছয়জন ছেলে রয়েছে। তারা আর্থিকভাবে অসচ্ছল অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে-মেয়েদের প্রলোভন দেখিয়ে অসামাজিক টিকটক ভিডিও তৈরি করে আসছিল। এরা নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। এদের একজনের ১৬ হাজারের বেশি ফলোয়ার রয়েছে। সে ভারতে টিকটক ভিডিও বানাতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতিও নিচ্ছিল। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ভারতের বেঙ্গালুরুতে বাংলাদেশি এক তরুণীকে নির্যাতনের ভিডিও গত ২১ মে ভাইরাল হয়। এ ঘটনায় জড়িতদের শনাক্তের চেষ্টা করা হয়। পরে ২৭ মে ভারতে এবং একইদিন নির্যাতনের শিকার ভুক্তভোগী নারীর বাবা বাদী হয়ে রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় মামলা করে। পরে এ ঘটনায় দুই নারীসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করে ভারতীয় পুলিশ। ওই ঘটনার তদন্তে নারী পাচারকারী বস রাফিসহ চারজনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। টিকটকের মাধ্যমে যদি অশালীন, অনৈতিক, কুরুচিপূর্ণ, নির্যাতনের মতো ভিডিও বানানোর অভিযোগ পাওয়া যায়। তবে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতিমধ্যে আমরা কিছু নারীর অভিযোগ পেয়েছি। সেগুলো খতিয়ে দেখছি। সত্যতা পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সাইবার অপরাধ ঠেকাতে র‌্যাবের সাইবার মনিটরিং সেল কাজ করছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে যারা কুরুচিপূর্ণ ও অশ্লীল ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে তাদের আইনের আওতায় আনতে র‌্যাব বদ্ধপরিকর। ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের ডিসি মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ বলেন, আমরা ইতিমধ্যে তিনজনকে গ্রেফতার করেছি। তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন আলামত উদ্ধার করা হয়েছে। অশ্লীল ভিডিও বানানোর সঙ্গে জড়িত অনেকের নাম পাওয়া গেছে। এদের সহযোগীসহ সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর