চট্টগ্রাম নগরের পানি নিষ্কাশনের অন্যতম মাধ্যম চাক্তাই খাল। এ খালের চকবাজার ধুনিরপুল থেকে চন্দনপুরা ব্রিজ পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার অংশ থেকে ১৫ দিনে ৯০ ট্রাক বর্জ্য তুলেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। প্রতি ট্রাকে বর্জ্য ছিল এক থেকে দেড় টন। এসব বর্জ্যরে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশই পলিথিন ও প্লাস্টিক। চাক্তাই খাল হয়ে এসব বর্জ্য সরাসরি গিয়ে পড়ছে কর্ণফুলী নদীতে।
কেবল চাক্তাই খাল নয়, নগরের ছোট-বড় ৩৭টি খালের মাধ্যমে নগরের পলিথিন-প্লাস্টিকসহ নানা বর্জ্য গিয়ে পড়ে এ নদীতে। ফলে পলিথিন-প্লাস্টিকের ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে কর্ণফুলী নদী। এর সঙ্গে আছে দখল, ভরাট, নগরের গৃহস্থালি-শিল্প-বাণিজ্য ও চিকিৎসা বর্জ্যরে দূষিত পানি ও অপচনশীল বর্জ্য। ফলে হুমকিতে পড়ছে নদীর জীববৈচিত্র্য। কমছে মৎস্য-প্রাণী। পাহাড়ি ঢল, শহরের শিল্প-বাণিজ্যের বর্জ্য, জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা কারণে ভরাট হচ্ছে নদী। কমছে গভীরতা। হুমকিতে পড়বে চট্টগ্রাম বন্দর এবং তৃতীয় শাহ আমানত সেতু।
জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দর ২০১৯ সালের মে মাসে কর্ণফুলী নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে ২৫৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘সদরঘাট থেকে বাকলিয়ার চর খনন’ শীর্ষক একটি প্রকল্পের কাজ শুরু করে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে তিনটি ছোট ‘সাকশন ড্রেজার’ দিয়ে খনন কাজ শুরু করলেও নদীর তলদেশে পলিথিনের স্তর জমায় খনন কাজ ব্যাহত হয়। ফেরত যায় ড্রেজারটি। পরে দেশীয় আধুনিক ‘গ্র্যাব ড্রেজার’ দিয়ে কাজ শুরু করে।
বন্দরের চিফ হাইড্রোগ্রাফার কমান্ডার ও প্রকল্প পরিচালক এম আরিফুর রহমান বলেন, কথা ছিল কর্ণফুলী নদীর তলদেশ থেকে ৪২ লাখ ঘনমিটার মাটি উত্তোলন করার। কিন্তু এখন তুলতে হবে ৫০ লাখ ঘনমিটার। বুয়েটের ভৌগোলিক বিশেষজ্ঞ টিমের পরামর্শে দেশি ‘গ্র্যাব ড্রেজার’ দিয়ে এখন খনন চলছে। তিনি বলেন, সদরঘাট থেকে চাক্তাই প্রায় আড়াই কিলোমিটার অংশ থেকে দিনে গড়ে প্রায় আট টন পলিথিন-প্লাস্টিকপণ্য, মাস্কসহ অপচনশীন দ্রব্য তোলা হয়। এগুলো ব্রিজ ঘাট এলাকায় শুকানোর পর আরেফিন নগরে ডাম্পিং করা হচ্ছে।
পরিবেশবিদ অধ্যাপক ইদ্রিস আলী বলেন, মানুষের শরীরে অতিরিক্ত চর্বি যেমন ক্ষতিকর, তেমনি পলিথিনও নদীকে ক্ষতি করে। নদীতে পলিথিন মাইক্রো প্লাস্টিক হয়ে মাছের ভিতরে প্রবেশ করে। এ মাছ খাচ্ছে মানুষ। পলিথিনে নষ্ট হচ্ছে নদীর স্বাস্থ্য। এ সমস্যা উত্তরণে এর ব্যবহার সীমিত ও যৌক্তিক করা, অবশ্যই রিসাইকেল করা এবং সেই পাটের কাছে ফিরে যাওয়া প্রয়োজন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মো. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, দূষণ-ভরাটের কারণে কর্ণফুলী নদীতে এখন ৮০ শতাংশ মাছও নেই। নগরের ৭০ লাখ মানুষের গৃহস্থালি, মলমূত্র, হাজারের অধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বর্জ্যে নদীটির প্রাণ এখন ওষ্ঠাগত। কেবল জোয়ার-ভাটা আছে বলেই এটিকে ‘বায়োলজিক্যাল ডেট’ বলা যাচ্ছে না। এখন কর্ণফুলীতে ফাইস্যা, কাঁচকি ও পোয়া মাছ ছাড়া আর কোনো বাণিজ্যিক মাছ নেই। কর্ণফুলী বাঁচাতে দরকার প্রযুক্তিনির্ভর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সুয়ারেজ সিস্টেট চালু ও বর্জ্য ফেলা বন্ধ করা।
পরিবেশ অধিদফতর চট্টগ্রাম মহানগরের পরিচালক মোহাম্মদ নূরুল্লাহ নূরী বলেন, নগরের ছোট বড় সব শিল্প কারখানা আমরা নিয়মিত মনিটরিংয়ে রাখি। গত ২৭ মে বিভিন্ন শিল্প কারখানায় অভিযান এবং গত ২১ জুন মোহরা এলাকার পাঁচটি বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের নির্গত পানির স্যাম্পল সংগ্রহ করা হয়েছে। তাছাড়া শিল্প কালুরঘাট এলাকার প্রতিষ্ঠানগুলোও আমাদের নজরে আছে।
চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আলিউর রহমান বলেন, কর্ণফুলী সেতুর পশ্চিম পাশের ভেড়া মার্কেট, রাজাখালী ও চাক্তাই খালের সংযোগস্থলে সোনালী মৎস্য আড়ত, চাক্তাই খালের পশ্চিম পাড় থেকে ফিরিঙ্গি বাজার পর্যন্ত পুরোটাই কর্ণফুলী নদী দখল করে হয়েছে। জেনারেল ইনফরমেশন সিপিএ ল্যান্ড ইউজ ২০১৪ প্ল্যানে এ সব স্থাপনার কোনো অস্তিত্ব নেই। ম্যাপে এসব স্থানে আছে নদী। তাই বন্দর চ্যানেলের স্বাভাবিক স্রোতধারা অব্যাহত রাখতে এসব স্থাপনা উচ্ছেদ করে তীরে গাইডওয়াল নির্মাণ জরুরি।
২০২৯ সালের ৪ থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম ধাপে টানা পাঁচ দিনের অভিযানে ২৩০টি স্থাপনা উচ্ছেদ ও প্রায় ১০ একর ভূমি উদ্ধার করা হয়। কিন্তু নিয়মিত তদারকির অভাবে ফের বেদখল হয়ে যাচ্ছে। পরিবেশ অধিদফতরের এক সমীক্ষায় বলা হয়, কর্ণফুলী দূষণের কারণে নদীর ৩৫ প্রজাতির মাছ এখন প্রায় বিলুপ্ত। এ নদীতে ৬৬ প্রজাতির মিঠা পানির, ৫৯ প্রজাতির মিশ্র পানির এবং ১৫ প্রজাতির সামুদ্রিক পরিযায়ী মাছ পাওয়া যেত। এখন মিঠা পানির ২০ থেকে ২৫ প্রজাতির এবং মিশ্র পানির ১০ প্রজাতির মাছ প্রায় বিলুপ্ত। জানা যায়, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের উদ্যোগে চুয়েট, জাইকার পরিবেশ বিষয়ক সাবেক গবেষক ও কর্ণফুলী নদী গবেষকদের সমন্বয়ে গঠিত টিম কর্ণফুলী নদীর শাহ্ আমানত ব্রিজ থেকে মনোহরখালী পর্যন্ত নদীর প্রস্থ নিয়ে একটি জরিপ চালায়। এতে বলা হয়, শাহ্ আমানত সেতু নির্মাণের সময় এডিবি মাস্টার প্ল্যান ও বিএস সিট অনুযায়ী ভাটার সময় নদীর প্রস্থ ছিল ৮৮৬ দশমিক ১৬ মিটার। এখন সেতুর নিচে ভাটার সময় নদীর প্রস্থ ৪১০ মিটার। তবে জোয়ারের সময় জেগে ওঠা চর অতিক্রম করে ৫১০ মিটার পর্যন্ত পানি হলেও ভরাট হওয়ার কারণে সেখানে নৌযান চলে না। রাজাখালী খালের মুখে গভীরতা ছিল ৯৮৯ মিটার, বর্তমানে ৪৬১ মিটার, চাক্তাই খালের মুখে ছিল ৯৩৮ মিটার, এখন ৪৩৬ মিটার। মেরিনার্স রোড হয়ে ফিরিঙ্গি বাজার এলাকায় নদীর প্রস্থ ছিল ৯৮১ মিটার, বন্দর সেখানে খনন করার পরও বর্তমান প্রস্থ ৮৫০ মিটার।