মঙ্গলবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা
অষ্টম কলাম

২০০ বছরেও পুলিশ ঢোকেনি যে গ্রামে!

নাসিম উদ্দীন নাসিম, নাটোর

নাটোরের সিংড়া উপজেলার চৌগাছা ইউনিয়নের একটি ছোট গ্রাম ‘হুলহুলিয়া’। ব্যতিক্রমী একটি উদ্যোগ গ্রামটিকে করে তুলেছে অনন্য সাধারণ। দেশের মানুষের কাছে হুলহুলিয়া এখন আদর্শ গ্রামের প্রতিচ্ছবি। এই গ্রামে নেই কোনো হানাহানি, কোনো অনাচার। গেল ২০০ বছরে অপরাধজনিত কারণে এ গ্রামে যায়নি পুলিশ। গ্রামের শতভাগ মানুষ শিক্ষিত। সাড়ে ৩ হাজার মানুষের এই গ্রামে হাজারো গল্প থাকলেও সেই গল্পে নেই কোনো সংঘাত, নেই ধর্ষণ, খুন কিংবা রাহাজানির মতো অনাচার। গ্রামটি বাল্যবিবাহ, মাদক ও যৌতুকমুক্ত। হুলহুলিয়া নাটোর জেলা সদর থেকে ৩৮ কিলোমিটার এবং সিংড়া থানা থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে চলনবিলের মাঝে অবস্থিত। ১১টি পাড়া নিয়ে গঠিত গ্রামের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ‘নিয়ামত খাল’ নামের একটি ছোট নদী, যা এ গ্রামের সৌন্দর্যকে অনেক গুণ বাড়িয়ে তুলেছে। শীতে এ গ্রামে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখি। কিন্তু পাখি মারার প্রবণতা নেই গ্রামবাসীর মধ্যে। গ্রামটিতে রয়েছে ছোট-বড় অনেক পুকুর।

গ্রামবাসী মনে করেন, শতভাগ শিক্ষিত হওয়ার কারণে মানুষের চিন্তা-ভাবনা ও মননে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। এ ছাড়া গ্রামটি পরিচালনার জন্য তাদের নিজস্ব সংবিধান রয়েছে। যা সবাই মেনে চলেন। গ্রামে কোনো সমস্যা-সংকট দেখা দিলে গ্রামবাসী মিলে সংবিধানের আলোকে তা সমাধান করেন। এ জন্য ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত তাদের একটি কমিটিও রয়েছে। এ ছাড়া স্কুল, মাদরাসা, বাজার, মসজিদ ও গোরস্তানভিত্তিক তাদের আলাদা আলাদা পরিচালনা কমিটিও রয়েছে। এ কমিটিও ভোটের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত হয়। গ্রামের জনসংখ্যা ৬ হাজার হলেও প্রায় ৪ হাজার মানুষ গ্রামের বাইরে চাকরি করেন। তারাও অর্থনৈতিকভাবে গ্রামবাসীকে বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করেন। ছেলেমেয়েদের জন্য এসএসসি পাস করা বাধ্যতামূলক। এসএসসি পাস না করালে কেউ তার মেয়েও বিয়ে দিতে পারেন না। দরিদ্রদের শিক্ষার জন্য রয়েছে দরিদ্র তহবিল। প্রতিটি বাড়িতেই এক বা একাধিক উচ্চশিক্ষিত মানুষ রয়েছেন।

এ গ্রামের ৬০ বছর বয়সী আবুল কালাম আজাদ বলেন, প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য এসএসসি পাস করা বাধ্যতামূলক। এসএসসি পাসের আগে কেউ তার মেয়েকে বিয়ে দিতে পারবে না। যদি কেউ কোনো কারণে তার মেয়েকে ১৮ বছরের পূর্বে বিয়ে দিতে চায় তাহলে, কেন বিয়ে দিতে চাচ্ছে তা জেনে সমাধান করা হয়। কিন্তু এসএসসি পাস না করে বিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। বিয়ের সময় যৌতুক নেওয়া ও দেওয়াও স¤পূর্ণ নিষেধ। গ্রামটি শতভাগ মাদকমুক্ত ও সবার জন্য স্যানিটেশনের ব্যবস্থা আছে।

বাংলাদেশের অন্যান্য গ্রাম থেকে হুলহুলিয়া যে কারণে পৃথক তার অন্যতম কারণ; এখানে রয়েছে হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ নামের একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান। একে উচ্চ আদালতও বলা হয়। এই পরিষদের মাধ্যমেই গ্রামের সব ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান এবং গ্রামবাসীর মধ্যে কখনো কলহ দেখা দিলে তা মীমাংসা করা হয়। সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের রয়েছে একজন চেয়ারম্যান ও একজন ভাইস চেয়ারম্যানসহ ২১ জন সদস্য। তারা সবাই গ্রামের পুরুষ ভোটারদের দ্বারা দুই বছরের জন্য নির্বাচিত হন। এ ছাড়া পাঁচ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটিও রয়েছে। এ ছাড়া গ্রামের বিচার বিভাগীয় আটটি পাড়াতেও আলাদা আলাদা কমিটি রয়েছে। যাকে বলা হয় নিম্ন আদালত। এ কমিটি পাড়ার আকার-আকৃতি অনুসারে ৫ থেকে ৮ সদস্যের হয়ে থাকে।

জানা গেছে, ১৯১৪-১৫ সালের দিকে একবার প্রবল বন্যায় ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় গ্রামে অভাব দেখা দেয়। গ্রামের অনেক চাষি ধান-বীজের অভাবে জমি ফেলে রাখতে বাধ্য হন। সবার মনে কষ্ট, হতাশা। বিষয়টি গ্রামের মাতবর মছির উদ্দিন মৃধার মনে দাগ কাটে। এক দিন গ্রামের প্রতিটি পরিবার থেকে একজন করে লোক ডেকে সভায় বসেন তিনি। সিদ্ধান্ত হয়, যাদের ঘরে অতিরিক্ত ধান-বীজ আছে, তারা বিনা শর্তে অন্যদের ধার দেবেন। সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়, খালি জমি ফসলে ভরে ওঠে। এতে উদ্বুদ্ধ হয়ে গ্রামের উন্নয়নে ১৯৪০ সালে ‘হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ’ নামে একটি পরিষদ গঠিত হয়।

এ গ্রামের সবাই শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সচেতন। গ্রামের দেড় শতাধিক সন্তান প্রকৌশলী, শতাধিক চিকিৎসক। আছেন কৃষিবিদ, আইনবিদ, প্রতিরক্ষা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও। বিচারক প্যানেল ও পরিষদের ওপর গ্রামবাসীর আস্থা আছে বলে তারা পরিষদের ওপরই নির্ভর করে। পরিষদের উদ্যোগে স্কুল, মাদরাসা, কবরস্থান, চলাচলের রাস্তা সবই তৈরি করা হয়েছে। এ সংগঠন ছাড়াও হুলহুলিয়ায় সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে আসছে শেকড় ও বটবৃক্ষ নামের দুটি সামাজিক সংগঠন। এ সংগঠনের অনুদানে গ্রামের অভাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি, অসহায় মানুষকে সহায়তা ও বেকারদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হয়।

সিংড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নূরে আলম সিদ্দিকী বলেন, নিজেরাই যদি নিজেদের সমস্যাগুলো সমাধান করা যায় তাহলে প্রশাসনের ওপর চাপ অনেকাংশেই কমে আসে। দেশের সব গ্রাম যদি হুলহুলিয়ার আদলেই গড়ে ওঠে তাহলে হয়তো বিশ্ব মানচিত্রে রূপকথার দেশ হিসেবে পরিচিতি পাবে বাংলাদেশ।

চৌগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুহাম্মাদ জাহেদুল ইসলাম ভোলা বলেন, পরিষদ থাকায় হুলহুলিয়া গ্রামে কোনো বিবাদ বা সংঘর্ষ হয় না বললেই চলে।

জেলা প্রশাসক শামীম আহম্মেদ বলেন, হুলহুলিয়া গ্রামের নিয়মনীতিগুলো যদি অন্যান্য গ্রামেও ব্যবহার করা হয় এবং সবাই মিলে সম্মিলিত প্রয়াসে সর্বদা ভালো কিছু করার মানসিকতা নিয়ে কাজ করা যায় তবে হুলহুলিয়া গ্রামের মতোই গড়ে উঠবে আরও অসংখ্য গ্রাম। এখানকার শান্তিপূর্ণ মনোভাব ও সমৃদ্ধির চেষ্টাকে দৃষ্টান্ত হিসেবে দেশের অন্যান্য গ্রামে ছড়িয়ে দেওয়া গেলে গড়ে উঠবে সুন্দর এক বাংলাদেশ।

সর্বশেষ খবর