শুক্রবার, ১৯ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

বিপর্যয়ের মুখে পোশাক রপ্তানি

খরচ বেড়েছে ১২ শতাংশ, ক্রয়াদেশ মোতাবেক শিপমেন্ট নিয়ে টেনশনে ব্যবসায়ীরা

রুহুল আমিন রাসেল

বিপর্যয়ের মুখে পোশাক রপ্তানি

ছয় কারণে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক পণ্যের রপ্তানি। পোশাকশিল্প মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ বলছে- সুতার দাম, অতিরিক্ত কনটেইনার, বন্দর, আইসিডি খরচ ও পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি এবং কাস্টমসের নিত্যনতুন সমস্যার কারণে সার্বিকভাবে পোশাক খাতে ১০ থেকে ১২ শতাংশ খরচ বেড়েছে। এতে করোনা সংকট উত্তরণ পর্বে পাওয়া বিপুল ক্রয়াদেশ মোতাবেক শিপমেন্ট নিয়ে টেনশনে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি- বিকেএমইএর কার্যকরী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন কারণে পোশাক পণ্যের উৎপাদন খরচ ১০ শতাংশ বেড়েছে। ক্রেতাদের থেকে যখন ইতিবাচক সাড়া পেলাম তার পরই এখন অভ্যন্তরীণ কিছু সমস্যার কারণে রপ্তানি বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন উদ্যোক্তারা। সঠিক সময়ে পণ্য জাহাজিকরণ এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ প্রতিদিনই কাস্টমস নিয়ে নতুন নতুন সমস্যার মুখে পড়ছেন রপ্তানিকারকরা। সুতার দাম কমানোসংক্রান্ত সমস্যার সমাধান হয়নি। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাব সরাসরি পড়বে পোশাকশ্রমিকসহ সাধারণ মানুষের ওপর। সব মিলিয়ে পোশাক মালিকরা একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মুখে পড়েছেন।’

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি-বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদুল আজিম গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সুতার দাম বৃদ্ধি, কনটেইনার ও বন্দর ফি, আইসিডি খরচ ও পরিবহন ব্যয়সহ সার্বিকভাবে পোশাকশিল্প উৎপাদন থেকে রপ্তানি পর্যায়ে ১০ থেকে ১২ শতাংশ খরচ বেড়েছে। এতে ক্রেতাদের কাছ থেকে যে বিপুল পরিমাণ ক্রয়াদেশ পাওয়া গেছে তা শিপমেন্ট নিয়ে টেনশনে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। সব মিলিয়ে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে পোশাক পণ্য রপ্তানি।’

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো-ইপিবির সবশেষ তথ্য বিশ্লেষণ বলছে- দেশের পোশাকপণ্য রপ্তানিকারকরা আবারও রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। অক্টোবরে বাংলাদেশ থেকে ৪ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি হয়েছে, যা এক মাসে এ যাবৎ সর্বোচ্চ। সাধারণত দেশের মোট রপ্তানির ৮৫ শতাংশই আসে এ খাত থেকে। বেশ কিছু কারণে গত মাসে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে। চীন, ভিয়েতনাম, ভারত ও মিয়ানমারে পোশাক উৎপাদনের খরচ বেড়ে যাওয়ায় সেসব দেশের বেশ কিছু অর্ডার আমাদের দেশে এসেছে। উন্নত দেশের বেশির ভাগ মানুষ ইতিমধ্যে ভ্যাকসিনের ডোজ সম্পন্ন করায় তাদের অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছে। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ক্রেতারা বড়দিনের সময় বিক্রি করার জন্য বাংলাদেশ থেকে বড় চালানে পণ্য কিনছেন। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই থেকে অক্টোবর) তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় এসেছে ১২ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২০ দশমিক ৭৮ শতাংশ বেশি। এ আয়ের ৭ দশমিক ২১ বিলিয়ন এসেছে নিটওয়্যার রপ্তানি থেকে। এ পণ্যের রপ্তানির প্রবৃদ্ধি ২৪ দশমিক ২৭ শতাংশ। ওভেন পোশাকের রপ্তানি ১৬ দশমিক ৪১ শতাংশ বেড়ে ৫ দশমিক ৪১ বিলিয়ন হয়েছে। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ সূত্র বলছেন- দেশে পোশাকশিল্প মালিকদের হাতে এখন ব্যাপক পরিমাণে ক্রয়াদেশ রয়েছে। কিন্তু সে ক্রয়াদেশ মোতাবেক  পণ্য সরবরাহ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে পালিত পরিবহন ধর্মঘটে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র চট্টগ্রাম বন্দরে বিশাল পণ্যজট সৃষ্টি হয়েছে। এতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন পোশাকশিল্পের মালিকরা। পণ্যজটের কারণে চলতি নভেম্বরে ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে বেসরকারি আইসিডিতে রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনারের ২৩ শতাংশ বর্ধিত চার্জ রহিত বা বাতিল করতে আইসিডি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোস অ্যাসোসিয়েশন-বিকডাকে অনুরোধ জানিয়েছে বিজিএমইএ। ১০ নভেম্বর বিকডাকে দেওয়া পত্রে বিজিএমইএ বলেছে- আকস্মিকভাবে আইসিডিতে বিভিন্ন চার্জ বৃদ্ধির ফলে দেশের সর্ববৃহৎ রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকশিল্পের রপ্তানি খরচ বাড়লে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। একতরফা ফি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত মোটেও যুক্তিসংগত ও ব্যবসাবান্ধব নয়। একতরফাভাবে হঠাৎ বিকডা কর্তৃক বিভিন্ন চার্জ বৃদ্ধির ফলে তৈরি পোশাকশিল্পের রপ্তানি আদেশগুলো কার্যকর করা কঠিন হয়ে পড়বে। এর আগে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বাড়তি ব্যয় সমন্বয়ের জন্য ৮ নভেম্বর এক সার্কুলারে পাঁচ খাতে ২৩ শতাংশ চার্জ বৃদ্ধির ঘোষণা দেয় বিকডা। এ চার্জ কার্যকর হয় ৪ নভেম্বর থেকে। এ প্রসঙ্গে বিকডা সভাপতি নুরুল কাইয়ুম খান বলেছেন, ‘ডিজেলের দাম বাড়ার কারণে আইসিডির বিদ্যমান আর্থিক সংকট আরও বেড়ে গেছে। পণ্যবাহী গাড়ি ও আইসিডির বিভিন্ন ইকুইপমেন্টের জ্বালানি ব্যয় বেড়েছে। মূলত সেগুলো সমন্বয় করতে ফুয়েল সারচার্জ আরোপ করা হয়।’ প্রসঙ্গত, ১৯টি বেসরকারি আইসিডিতে শতভাগ রপ্তানি পণ্য কনটেইনার বোঝাই করে জাহাজিকরণের জন্য বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়। এ ছাড়া খাদ্যপণ্যসহ ৩৭ ধরনের আমদানি পণ্য জাহাজ থেকে বন্দরে নামানোর জন্য সেগুলো ডিপোয় এনে খালাস করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের ১ থেকে ২৬ কিলোমিটারের মধ্যে এসব আইসিডি অবস্থিত। এদিকে বিজিএমইএ পণ্য জটসংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে জানিয়েছে- ৫ থেকে ৮ নভেম্বর পর্যন্ত চার দিনের পরিবহন ধর্মঘটের কারণে পণ্যবাহী ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান চলাচল বন্ধ ছিল। ফলে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আমদানি হওয়া পণ্য চালান খালাস ও প্রাইভেট আইসিডিগুলো থেকে রপ্তানিবাহী পণ্য চালান চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে জাহাজিকরণ সম্ভব হয়নি। ধর্মঘটের চার দিনে প্রায় ১২ হাজার টিউজ আমদানি পণ্য চালান খালাস ও প্রায় ৫ হাজার টিউজ রপ্তানিবাহী পণ্য চালান জাহাজিকরণ করা সম্ভব হয়নি। ফলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর এয়ার শিপমেন্ট ডিসকাউন্টসহ রপ্তানি আদেশ বাতিলের আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া আমদানি হওয়া চালান খালাস করতে না পারার কারণে উৎপাদনে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েও রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে। ফলে চলতি নভেম্বরে ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর