শুক্রবার, ১৯ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

কুমিল্লার মাছের উচ্ছিষ্ট যাচ্ছে চীন-জাপান

মহিউদ্দিন মোল্লা, কুমিল্লা

কুমিল্লার মাছের উচ্ছিষ্ট যাচ্ছে চীন-জাপান

গোমতী নদীর দক্ষিণ পাড়। এই পাড় দিয়ে চলে গেছে আমতলী-বিবির বাজার সড়ক। সেখানে কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার ঝাঁকুনিপাড়া এলাকা। ঝাঁকুনিপাড়া অতিক্রম করতে নাকে লাগবে মাছের গন্ধ। অনেকটা শুঁটকিখোলায় মাছ শুকাতে দেওয়ার গন্ধের মতো। তেরপলে রোদে শুকানো হচ্ছে সাদা রঙের কিছু। কাছে গেলে ভুল ভাঙবে। এ তো মাছের আঁশ। ছয়জন যুবক এখানে কাজ করছেন। কেউ মাছের আঁশ পরিস্কার করছেন, কেউ সেই আঁশ রোদে উল্টে দিচ্ছেন। মাছের যে আঁশ ফেলে দেওয়া হতো উচ্ছিষ্ট হিসেবে, সেই উচ্ছিষ্টই রপ্তানি করা হচ্ছে চীন-জাপানে। মাছের আঁশ দিয়ে ঘরের শো-পিস, ক্যাপসুলের বাহ্যিক অংশ ও গয়না তৈরি করা হচ্ছে। মাছের আঁশে সচ্ছলতা এসেছে অনেক পরিবারে। এখানে মাছের আঁশ শুকানোর উদ্যোক্তা মো. মাহবুব আলম। তার বাড়ি নগরীর সংরাইশ এলাকায়। মাহবুবের মতো নগরীর আরও দুই ব্যক্তি মাছের আঁশ সংগ্রহ করেন। আঁশ শুকানো শ্রমিকদের একজন বিল্লাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমরা ছয়জন আঁশ শুকানোর কাজ করি। সবার বাড়ি মুরাদনগরের নহল চৌমুহনী। মাছের আঁশ শুকানো দেখতে অনেক মানুষ আসে। জানতে চায় এগুলো দিয়ে কী হয়।’ ফোন পেয়ে আঁশ শুকানোর স্থানে আসেন মাহবুব আলম। নদীর পাড়ে মোটরসাইকেল রেখে নিচে আঁশ শুকানোর স্থানে নামেন। গায়ে সাদা রঙের সুতির দামি পাঞ্জাবি। চোখে দামি সানগ্লাস। মাহবুব আলম বলেন, ‘অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি। জীবনে অনেক পরিশ্রম করেছি।’ নগরীর রাজগঞ্জ মাছ বাজারে নানার বাড়ি সূত্রে একটি ঘর পেয়েছেন মাহবুব। সেখানে তিনিসহ কয়েকজন মাছ কাটতেন। বছর দশেক আগে তার কাছে নারায়ণগঞ্জ সাইনবোর্ড এলাকার এছহাক ব্যাপারী নামের একজন লোক আসেন। তিনি মাছের আঁশ কেনার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি শুকানো ১০ কেজি মাছের আঁশ বিক্রি করে পেয়েছিলেন ৪০০ টাকা। সেই থেকে শুরু।  তিনি রাজগঞ্জ মাছ বাজারের ১৮টি দোকান থেকে মাছের আঁশ সংগ্রহ করেন।

এ ছাড়া নগরীর বাদশা মিয়া বাজার, টমসমব্রিজ, কোটবাড়ী, পদুয়ার বাজার, চৌয়ারা, মগবাড়ী ও সেনানিবাসসহ বেশ কয়েকটি বাজার থেকে মাছের আঁশ সংগ্রহ করেন মাহবুব। প্রতিদিন গড়ে ১০০ কেজি আঁশ সংগ্রহ করেন তিনি।

 মাসে প্রায় ৩ টন। রোদে শুকানোর পর প্রতি কেজি আঁশ ৪০ টাকা দরে বিক্রি করেন। আঁশ শুকানোর জন্য তার ছয়জন কর্মচারী রয়েছে। প্রত্যেককে থাকা-খাওয়াসহ মাস শেষে ১০ হাজার টাকা করে বেতন দিতে হয়। সব খরচ বাদে প্রতি মাসে এখন তার ভালোই লাভ হয়। মাহবুব জানান, ঢাকা থেকে যারা তার কাছ থেকে শুকনো আঁশগুলো কেনেন তারা চীন, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়ায় এগুলো রপ্তানি করেন। মাছের আঁশ দিয়ে ঘরের শো-পিস, ওষুধ, ক্যাপসুলের বাহ্যিক অংশ ও গয়না তৈরি করা হয়। তিনি বলেন, ‘১০ বছর আগে যে আঁশ কেজি ৪০ টাকা ছিল তা মাঝে কমে যায়। এখন তা আবার ৪০ টাকা হয়েছে। দাম বাড়লে আমরা ভালো লাভ করতে পারতাম।’ মাহবুব বলেন, ‘প্রথম প্রথম এ কাজ দেখে অনেকেই নাক সিটকাত। দুর্গন্ধ বলে দূরে থাকত। তবে আমি কাজ চালিয়ে যেতাম। কোনো কাজই ছোট নয়। কাজকে ভালোবাসলে মানুষের সম্মান বৃদ্ধি পায়। বিদেশে এসব কাজের অনেক মূল্য। দেবিদ্বারের স্নাতক পাস এক ছেলে এসে কাজ শিখেছে। সে বিদেশে গিয়ে এখন মাসে বাড়িতে লাখ টাকা পাঠায়। যারা এ কাজে নাক সিটকাত তারা এখন দেখতে আসে। এ কাজ আমার পরিবারে সচ্ছলতা এনেছে। মাছ কাটা ও আঁশ শুকানোর মাধ্যমে কিছু মানুষের কাজের সুযোগ করে দিতে পেরে ভালো লাগছে। ভবিষ্যতে আরও বেশি মানুষের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে চাই।’ ব্যবসায়ী নেতা শাহ মোহাম্মদ আলমগীর খান বলেন, ‘মাহবুব আলমের মাছের আঁশ সংগ্রহ ও বিক্রি ব্যবসায় নতুন সংযোজন। তার দেখাদেখি এ ব্যবসায় আরও অনেক তরুণ এগিয়ে আসছে। তাদের এগিয়ে দিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানাচ্ছি।’ বিসিক কুমিল্লার ডিজিএম মিরাজ শফিক বলেন, ‘ফেলনা উচ্ছিষ্টকে যারা সম্পদে পরিণত করছেন তারাই প্রকৃত উদ্যোক্তা। মাহবুব আলমের ব্যতিক্রমী উদ্যোগ অনেকের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে। আমরা তাকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করব।’

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর