মঙ্গলবার, ৩০ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

ডেল্টার চেয়ে জটিলতা কম ওমিক্রনে

সংক্রমণ ক্ষমতাও কম : ড. বিজন । প্রতিরোধে ১৫ পদক্ষেপ । সতর্ক সরকার

উবায়দুল্লাহ বাদল ও জয়শ্রী ভাদুড়ী

ডেল্টার চেয়ে জটিলতা কম ওমিক্রনে

করোনাভাইরাসের আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থান নিয়েছে সরকার। ওমিক্রন যাতে দেশে প্রবেশ ও ছড়িয়ে পড়তে না পারে সে জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ জন্য করণীয় নির্ধারণ করতে আজ সকাল ১০টায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে বৈঠক আহ্বান করা হয়েছে। বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। বৈঠক থেকে পরবর্তী করণীয় ও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হতে পারে। সে ক্ষেত্রে কঠোর বিধিনিষেধ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলে আগের মতোই প্রজ্ঞাপন জারি করবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এদিকে ওমিক্রন নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে রাজধানীসহ সারা দেশের জন্য সতর্কতামূলক ১৫ দফা নির্দেশনা জারি করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। নির্দেশনায় আক্রান্ত দেশসমূহ হতে আগত যাত্রীদের ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করাসহ সর্বক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, ওমিক্রন যেন কোনোভাবেই দেশে প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য আকাশপথ, স্থল, সমুদ্রবন্দরসমূহে কঠোর সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ দেশের অন্যান্য স্থল, সমুদ্রবন্দরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত যাত্রীদের নজরদারি করা হচ্ছে। বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আগত যাত্রীদের দিকে কঠোর নজরদারি ও মনিটরিং করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিভিন্ন দেশ থেকে সরাসরি ফ্লাইট না থাকলেও মধ্যবর্তী বিভিন্ন দেশ হয়ে যাত্রীদের বাংলাদেশে আসার সুযোগ রয়েছে। তাই আফ্রিকা এবং ওমিক্রন শনাক্ত দেশ থেকে কোনো যাত্রী বাংলাদেশে আসছে কি না সেদিকে কঠোর নজরদারি রাখা হচ্ছে। এ অবস্থায় বন্দরগুলোর করণীয় কী তা নির্ধারণে শিগগিরই আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকে বসার কথা রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, মন্ত্রিপরিষদ সচিব দেশের বাইরে রয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে মঙ্গলবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে বৈঠক হবে। করোনাভাইরাস প্রতিরোধ সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির সদস্যরাও সেখানে মতামত দেবেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। প্রয়োজনে আগের মতো কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হতে পারে।

ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট প্রসঙ্গে অনুজীব বিজ্ঞানী ড. বিজন কুমার শীল গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এ মাসের শেষ নাগাদ বিজ্ঞানীদের রাডারে ধরা পড়েছে ওমিক্রন। কিন্তু এই ভ্যারিয়েন্টটি মার্চ মাসে তানজানিয়া থেকে আসা তিন বিমান যাত্রীর দেহে প্রথম চিহ্নিত হয়েছিল। এরপর মিউটেশন হয়ে ওমিক্রন এ পরিস্থিতিতে এসেছে। তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ডেল্টার স্পাইক প্রোটিনের পিসিএসে টি৬৮১ আরজেনিন ছিল। এটা ‘শক্তিশালী পজিটিভ চার্জ’। এর ফলে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সেলে প্রবেশ ক্ষমতা, অ্যাসেম্বল করার ক্ষমতা এবং ছড়ানোর ক্ষমতা বেশি। এর ফলে ডেল্টা বেশি সংক্রামক এবং আক্রান্ত রোগীর পরিস্থিতি জটিল করে তুলতে পারে। ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে যে তথ্য এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে তাতে দেখলাম স্পাইক প্রোটিনের পিসিএসে টি৬৮১ হিসটিডিন আছে। এটা ‘লো পজিটিভ চার্জ’। এর ফলে সেলে প্রবেশ ক্ষমতা, অ্যাসেম্বল ক্ষমতা এবং ছড়ানোর ক্ষমতা তুলনামূলক কম। এই সিকোয়েন্সিং ডেল্টার চেয়ে তুলনামূলক দুর্বল। কিন্তু ভাইরাস প্রতিনিয়ত মিউটেশন করছে। এ পর্যন্ত ৫০টি মিউটেশন হয়েছে, এর সিংহভাগই স্পাইক প্রোটিনে হয়েছে। বারবার মিউটেশন করলে আরও শক্তিশালী হতে পারে আবার দুর্বলও হতে পারে। দেশে এই ভ্যারিয়েন্ট প্রবেশ করেছে কি না এ জন্য সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি দেশে আসা ফ্লাইটগুলোর ট্যাংকে জমা হওয়া ব্যবহৃত পানি। যাত্রীরা কফ, থুথু ফেললে সেগুলো পানিতে মেশে। পানি আরটি-পিসিআরে টেস্ট করলে ভাইরাসের উপস্থিতি মিলবে। এরপর সেখান থেকে জিনোম সিকোয়েন্সিং করলে ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত করা যাবে। পানিতে করোনার ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট মিললে বুঝতে হবে দেশে ভ্যারিয়েন্ট ঢুকেছে। বিমানবন্দরে আরটি-পিসিআর টেস্টের ব্যবস্থা রয়েছে। কর্তৃপক্ষ চাইলেই বিজ্ঞানসম্মত এ পদক্ষেপ নিতে পারে। ১৫ দফা নির্দেশনা : করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে রাজধানীসহ সারা দেশের জন্য সতর্কতামূলক ১৫ দফা নির্দেশনা জারি করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। নির্দেশনাগুলো হলো-১. সাউথ আফ্রিকা, নামিবিয়া, জিম্বাবুয়ে, বতসোয়ানা, এসওয়াতিনি, লেসোথো এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক সময় সময় ঘোষিত অন্যান্য আক্রান্ত দেশ হতে আগত যাত্রীদের বন্দরসমূহে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও স্ক্রিনিং জোরদার করতে হবে। ২. সব ধরনের সামাজিক/রাজনৈতিক/ধর্মীয়সহ অন্যান্য জনসমাগম নিরুৎসাহিত করতে হবে। ৩. বাড়ির বাইরে প্রত্যেককে সর্বদা সঠিকভাবে নাক, মুখ ঢেকে মাস্ক পরাসহ সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে হবে। ৪. রেস্তোরাঁতে বসে খাওয়ার ব্যবস্থা ধারণক্ষমতার অর্ধেক বা তার কম করতে হবে। ৫. সব প্রকার জনসমাবেশ, পর্যটন স্থান, বিনোদন কেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার, সিনেমা হল/থিয়েটার ও সামাজিক অনুষ্ঠানে (বিয়ে, বৌভাত, জন্মদিন, পিকনিক, পার্টি ইত্যাদি) ধারণক্ষমতার অর্ধেক বা তার কম সংখ্যক লোক অংশগ্রহণ করতে পারবে। ৬. মসজিদসহ সব উপাসনালয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে হবে। ৭. গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে হবে। ৮. আক্রান্ত দেশসমূহ হতে আগত যাত্রীদের ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে হবে। ৯. সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে হবে। ১০. সব স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে সেবাগ্রহীতা, সেবা প্রদানকারী ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সর্বদা সঠিকভাবে নাক, মুখ ঢেকে মাস্ক পরাসহ সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে হবে। ১১. স্বাস্থ্যবিধি মেনে ভ্যাকসিন কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। ১২. করোনার উপসর্গ/লক্ষণযুক্ত সন্দেহজনক ও নিশ্চিত করোনা রোগীর আইসোলেশন ও করোনা পজিটিভ রোগীর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসা অন্যান্যদের কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে হবে। ১৩. করোনার লক্ষণযুক্ত ব্যক্তিকে আইসোলেশনে রাখা এবং তার নমুনা পরীক্ষার জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করে সহায়তা করা যেতে পারে। ১৪. অফিসে প্রবেশ এবং অবস্থানকালীন বাধ্যতামূলকভাবে নাক, মুখ ঢেকে মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা দাফতরিকভাবে নিশ্চিত করতে হবে এবং ১৫. করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও হ্রাস করার নিমিত্তে কমিউনিটি পর্যায়ে মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার সচেতনতা তৈরির জন্য মাইকিং ও প্রচারণা চালানো যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে মসজিদ/মন্দির/গির্জা/প্যাগোডার মাইক ব্যবহার করা যেতে পারে এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলর/ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যসহ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা যেতে পারে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর