মঙ্গলবার, ২৪ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

ভেজাল প্রসাধনীতে ঝুঁকিতে স্বাস্থ্য

বাড়ছে ত্বকের সংক্রমণ ও ক্যান্সার, প্রতারিত ক্রেতারা, হাটবাজার-অনলাইন সর্বত্র সক্রিয় প্রতারক

জিন্নাতুন নূর

ভেজাল প্রসাধনীতে ঝুঁকিতে স্বাস্থ্য

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের এক পেজে একজন নারী রং ফরসাকারী ক্রিম বিক্রি করেন। প্রায় রাতেই লাইভে এসে তিনি সেই ক্রিম নিজের মুখে মেখে এর গুণাগুণ ব্যাখ্যা করেন। লাইভে অনেক নারী তার কাছে পণ্যটি কিনতে অর্ডারও দেন। অনেকে সেই ক্রিম কেনেনও। কিন্তু সমস্যা হয় কিছুদিন পরই। অনলাইনের ভেজাল এসব পণ্য কিনে নিজের অজান্তেই ক্রেতারা প্রতারিত হয়ে ছুটে যাচ্ছেন চর্মরোগ চিকিৎসকের কাছে। ব্যবহারকারীর ত্বকে সংক্রমণ এবং ত্বক লাল হয়ে যাওয়াসহ নানা ধরনের সমস্যা তৈরি হলে তবেই বুঝতে পারেন অনলাইন থেকে কেনা দামি ক্রিমটি আসলে ছিল ভেজাল একটি প্রসাধনী।

চিকিৎসকরা জানান, সারা পৃথিবীতে কোথাও রং ফরসাকারী ক্রিম ব্যবহার করে স্থায়ীভাবে ফরসা হওয়ার উদাহরণ নেই। অথচ বেনামি প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ছাড়াই তাদের পণ্য ব্যবহারের পর অনেক ভালো ফল পাওয়ার দাবি করে ক্রেতার কাছে পণ্য বিক্রি করছে। আর দীর্ঘ মেয়াদে এসব পণ্য ব্যবহারে ত্বকের ক্যান্সার ও গর্ভজাত সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ ভেজাল এসব পণ্যে থাকে মার্কারি ও পারদজাতীয় বিভিন্ন উপাদান। আর পারদজাতীয় ভারী ধাতু শরীর থেকে বের হতে পারে না। শরীরে দীর্ঘ সময় অবস্থানের ফলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। পারদ ত্বকের ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। এ ছাড়া হাইড্রোকুইনন ক্রিম (ব্রণের জন্য ব্যবহার হয়) ত্বকের স্বাভাবিক গঠন পরিবর্তন করে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. রাশেদ মোহাম্মদ খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘রং ফরসাকারী ক্রিম, ব্রণ বা মেছতার ক্রিম মেখে ত্বকের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে আমাদের কাছে এখন অনেক রোগী চিকিৎসা নিতে আসছেন। ধারণা করছি ভেজাল এসব প্রসাধনীতে স্টেরয়েডের মতো পদার্থ ব্যবহার করা হচ্ছে। এর ব্যবহারে মুখের ত্বক পাতলা হয়ে যায়, ত্বকের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাও অনেক কমে যায়। এর ফলে ত্বকে বিভিন্ন ধরনের ইনফেকশন হয়। এ ধরনের ক্রিমগুলো দীর্ঘদিন ব্যবহারে ত্বকের ক্ষতি হয়। পাশাপাশি ত্বকের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকিও বেড়ে যায়।’

ভেজাল প্রসাধনী নিয়ে যারা অভিযান পরিচালনা করেন তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে, চীন থেকে বিশ্বের নামিদামি কোম্পানির নকল হলোগ্রাম ও বিভিন্ন প্রসাধনীর মোড়ক অবৈধ উপায়ে দেশে আনা হয়। সেগুলো দিয়ে পরে নকল ও ভেজাল প্রসাধনীকে বিশ্বমানের পণ্যে রূপান্তর করা হয়। আজকাল পাড়া-মহল্লার পারলারে বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড লরিয়েল, মেরিকো ও ম্যাট্রিক্সের মতো প্রসাধনসামগ্রী পাওয়া যায়। এসব পণ্য চকবাজারে বিক্রির পাশাপাশি অনলাইনেও দেদার বিক্রি হচ্ছে। ক্ষতিকর রাসায়নিক দিয়ে তৈরি এসব নকল পণ্য রাজধানীসহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। এ ছাড়া দেশের বাইরে থেকে লাগেজ পার্টিও দেশে বিপুল পরিমাণ ভেজাল প্রসাধনী আনছে। সম্প্রতি রাজধানীর কামরাঙ্গীর চরে ভেজাল প্রসাধনীর একটি কারখানার সন্ধান পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। এ কারখানায় বিশ্বের নামিদামি ব্র্যান্ডের বডিলোশন, হেয়ার স্পা ক্রিম, হোয়াইটনিং লেজার ফেসপ্যাকসহ বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনসামগ্রী জব্দ করা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পুরান ঢাকা থেকে পণ্যের চাহিদা অনুযায়ী ব্যবসায়ীরা রাসায়নিক নিয়ে আসেন। কারখানার বিশেষ মেশিনে প্রসাধনীটি তৈরির পর তা বোতলজাত করা হয়। পরে নামিদামি ব্র্যান্ডের লেবেল লাগানো হয়। এসব ভেজাল পণ্য ব্যবসায়ীরা কারখানা থেকে সরাসরি নিয়ে যান পুরান ঢাকার চকবাজারে। পরে সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন পারলার, সেলুন ও প্রসাধনীর দোকানে। সাধারণত চাহিদামতো রাসায়নিক পাওয়া গেলে অসাধু চক্রটি গোপন কারখানায় এসব পণ্য কৌটায় ভরে পরে সেগুলো প্রক্রিয়াজাত করে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করে। আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে, জেলা শহরগুলোয়ও এখন ভেজাল প্রসাধনসামগ্রী তৈরি করা হচ্ছে। সম্প্রতি ভ্রাম্যমাণ আদালতের পরিচালিত অভিযান থেকে জানা যায়, খালি বোতলে নামিদামি ব্র্যান্ডের স্টিকার তৈরি করে সেখানে বিএসটিআইর লোগো ব্যবহার করে একটি চক্র ভেজাল প্রসাধনসামগ্রী বাজারে সরবরাহ করছে। এসব পণ্যে যদিও দেশ-বিদেশের ফরমুলা ব্যবহার এবং ঢাকার চকবাজারে পণ্যটি তৈরি করার বিষয়ে লেখা থাকে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা ভিন্ন। গ্লিসারিন, তেল, রং ফরসাকারী ক্রিম ও সুগন্ধিজাতীয় প্রসাধনী গোপন কারখানায় তৈরির প্রমাণ মিলেছে। আবার বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডেড পণ্যের মোড়ক বা কৌটা হুবহু নকল করে তৈরি করে এনেও তা দেশের বাজারে আসল বলে চালিয়ে দিচ্ছে ভেজাল প্রসাধনী তৈরির একটি সিন্ডিকেট। মূলত চীন থেকে বিখ্যাত ব্র্যান্ডের প্রসাধনীর কৌটা বা পাত্র নকল করে বানিয়ে এনে তা কেরানীগঞ্জ বা চকবাজারের গোডাউনে রিফিল করে বাজারে আসল পণ্য বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্র্যান্ডের শ্যাম্পু ট্রেসেমের একটি বোতল চীন থেকে হুবহু নকল করে বানিয়ে আনতে এসব অসাধু ব্যবসায়ীর খরচ পড়ে ১৫০ টাকা। কিন্তু বাজারে যদি এ শ্যাম্পু ৫০০ টাকায় বিক্রি করা হয় তাহলে সেই ব্যবসায়ীর প্রতি বোতলে ৩৫০ টাকা লাভ থাকে। বিপণিবিতান ছাড়াও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের অসংখ্য পেজে বিভিন্ন নামিদামি ব্র্যান্ডের নামে নকল প্রসাধনসামগ্রী বিক্রি করা হচ্ছে। দেখতে আসল প্রসাধনীর মতো মনে হলেও এর বেশির ভাগই রেপ্লিকা বা নকল। ক্রেতারা আসল ভেবে বেশি দাম দিয়ে নকল পণ্য কিনে প্রতারিতও হচ্ছেন। এর বেশির ভাগ পণ্যে নেই বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) অনুমোদন। বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ভেজাল প্রসাধনী ব্যবহারের ফলে ত্বকের চামড়া পাতলা হয়ে যাওয়া, ত্বকে লোমের পরিমাণ বৃদ্ধি, ত্বকে বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ হওয়া, লোমের গোড়ায় ফোঁড়াসহ ত্বকে ভাঁজ পড়ে যায়। আশঙ্কার বিষয়, এর ফলে গর্ভবতী নারীর ভ্রƒণটির স্নায়ুবিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে জন্ম নেওয়া সন্তানটি মানসিক পঙ্গুত্বের শিকার হয়। বিএসটিআইর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ভেজাল প্রসাধনীর বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য আমরা চেষ্টা করছি। এর পরও ভেজাল প্রসাধনীর বেচাকেনা যে বন্ধ হয়ে গেছে এমন নয়। প্রতারকরা খুব গোপনে গভীর রাতে কাজ করে। এদের খুঁজে বের করতে হলে পেছনে লেগে থাকতে হবে। কিন্তু এজন্য বড় জনবলেরও প্রয়োজন। অথচ বিএসটিআইর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এখন মাত্র তিনজন।’ জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নকল প্রসাধানীর বিরুদ্ধে আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করি। অনলাইন পেজগুলো থেকে যে প্রসাধনীগুলো ক্রেতারা কিনছেন সেগুলো কেনার ব্যাপারে সতর্ক করছি। এ ছাড়া অনলাইন পেজ থেকে কোনো পণ্য কিনে প্রতারিত হলে ভোক্তা অধিদফতরে তারা অভিযোগ করতে পারবেন। কিন্তু অনেক পেজের অ্যাডমিন ক্রেতাকে প্রতারিত করার পর পেজে দেওয়া মোবাইল নম্বরটি আর ধরেন না। পুরান ঢাকায় অভিযান চালিয়ে আমরা যে ভেজাল পণ্যের কারখানা পেয়েছি সেগুলো সিলগালা করে দিয়েছি। এ ছাড়া বাড়িমালিকদের মধ্যে নকল প্রসাধানীর ব্যবসা যারা করেন তাদের এ ব্যাপারে সচেতন করেছি। মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ী সমিতিও এখন যেখানে নকল প্রসাধনী পাচ্ছে তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানাচ্ছে। যেহেতু পুরান ঢাকার মৌলভীবাজার থেকে নকল প্রসাধনী সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে, এ স্থান থেকেই এসব পণ্য আটকে দেওয়ার চেষ্টা করছি।’

সর্বশেষ খবর