শনিবার, ২৫ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

বন্যায় দুর্ভোগ বাড়ছেই

প্রতিদিন ডেস্ক

বিভিন্ন নদ-নদীর পানি নামতে থাকলেও বন্যাজনিত দুর্ভোগ কেবল বেড়েই চলছে। দুর্গত এলাকাগুলোতে নানা ক্ষেত্রে সংকটসহ রোগবালাই ছড়িয়ে পড়ছে। একই সঙ্গে বন্যার পানিতে মিলছে ভেসে আসা লাশ। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

ময়মনসিংহ : ফুলপুরে বন্যার পানিতে ভেসে আসা ইব্রাহিম খলিল (৪৫) নামের একজনের মৃতদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। গতকাল দুপুর ১টার দিকে উপজেলার সিংহেশ্বর ইউনিয়নের বাইরাখালী এলাকার মালিঝি নদী থেকে ভাসমান অবস্থায় থাকা মৃতদেহটি উদ্ধার করা হয়। তিনি শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার বালুঘাটা গ্রামের ইয়াকুব আলী মুন্সীর ছেলে। নিহতের স্বজনরা জানান, গত ৯ জুন সকাল ১০টার দিকে ইব্রাহিম খলিল তার শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে নকলা এবং নালিতাবাড়ী থানার মধ্যবর্তী মালিঝি (ভোগাই) নদী পার হওয়ার সময় নৌকা থেকে পড়ে গিয়ে নিখোঁজ হন।

জামালপুর : জামালপুরে পানি কমতে শুরু করায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। তবে যমুনা নদীর পানি এখনো বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে গতকাল ইসলামপুর উপজেলার গাইবান্ধা ইউনিয়নের বলিদাপাড়া গ্রামে খোদু আকন্দের মেয়ে ইরশেদা (১১) ও একই গ্রামের ছানোয়ার হোসেন আকন্দের মেয়ে শায়লা (১২) বন্যার পানিতে গোসল করতে গিয়ে স্রোতে ভেসে যায়। পরে তাদের একজনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। অন্যজন নিখোঁজ। এ ছাড়াও বকশীগঞ্জে বন্যার পানিতে ডুবে এক মৃগী রোগীর মৃত্যু হয়েছে।

সিলেট : সিলেটে সব নদীর পানি হ্রাস পাচ্ছে। ফলে বন্যা পরিস্থিতিরও উন্নতি হচ্ছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় তীরবর্তী উপজেলাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছিল। কিন্তু গতকাল থেকে কুশিয়ারা তীরবর্তী ৬ উপজেলার কোথাও উন্নতি ও কোথাও অবস্থা অপরিবর্তিত ছিল। সুরমা, ধলাই, পিয়াইন, লোভা ও সারি নদীর তীরবর্তী উপজেলাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্র থেকে লোকজনও বাড়ি ফেরা শুরু করেছে। তবে বন্যার পানি কমলেও মানুষের দুর্ভোগ কমছে না। এখনো অনেক দুর্গম এলাকায় পর্যাপ্ত পরিমাণ ত্রাণ পৌঁছানো সম্ভব না হওয়ায় সেসব এলাকায় বন্যাকবলিত লোকজনের মধ্যে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির জন্য হাহাকার চলছে। নৌকার অপর্যাপ্ততার জন্য অনেক স্থানে ত্রাণ পৌঁছানো যাচ্ছে না। 

সুনামগঞ্জ :  সুনামগঞ্জের বন্যাকবলিত এলাকা থেকে বানের পানি নামতে শুরু করায় আশ্রয় কেন্দ্র থেকে অনেকেই ফিরে আসছেন। তবে ঘরে ফেরার পর তারা যে দৃশ্য দেখেছেন, তাতে কেবলই হতাশ হচ্ছেন। টানা এক সপ্তাহ ঘর-গৃহস্থালির মূল্যবান সামগ্রী পানির নিচে তলিয়ে থাকায় বেশির ভাগই নষ্ট হয়ে গেছে। ঘরে মজুদ খাবার, ইলেকট্রনিক সামগ্রী, কাপড়চোপড়, আসবাবপত্রসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিসই ভিজে গেছে।

যেগুলো একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে সেগুলো ফেলে দিতে হচ্ছে, হোক সেটা যত মূল্যবান। বাকিগুলো শুকিয়ে কোনোমতে কাজ চালানোর চেষ্টা করছেন তারা।

দুর্গতরা বলছেন, এবারের বন্যার যে ভয়াবহতা, ক্ষয়ক্ষতির যে পরিমাণ সেটা কাটিয়ে উঠতে আরও বেশি সরকারি-বেসরকারি সাহায্য প্রয়োজন। ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে প্রয়োজন দীর্ঘ মেয়াদি সরকারি উদ্যোগ।

হবিগঞ্জ : হবিগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। হবিগঞ্জ সদর, আজমিরীগঞ্জ, বানিয়াচং, নবীগঞ্জ, মাধবপুর ও লাখাই উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা অবনতি হয়েছে। ৭টি উপজেলার ৫১টি ইউনিয়নে বন্যাকবলিত বানভাসিদের জন্য ২৫৩টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয় কেন্দ্রে ত্রাণের জন্য চলছে হাহাকার।

কুড়িগ্রাম :  কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র ও ধরলা নদীর পানি গত ৮-১০ দিন ধরে বিপৎসীমার ওপরে অবস্থান করায় পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন প্রায় দেড় লাখ মানুষ। তাদের বাড়ির নলকূপ-ল্যাট্রিন তলিয়ে গেছে। নষ্ট হয়ে গেছে গবাদি পশুর খড়। ফলে গো-খাদ্য আর বিশুদ্ধ পানির সংকটে ভুগছেন তারা। বাড়ির বয়স্ক ও নারীরা স্বাভাবিকভাবে ল্যাট্রিন ব্যবহার করতে না পেরে ভীষণ ভোগান্তির মধ্যে রয়েছেন। শুকনো জ¦লানি না থাকায় অনেক কসরত করে রান্না করতে হচ্ছে তাদের। ফলে একবেলা রান্না করে সেই রান্না দিয়ে দিন পার করছেন তারা।

সিরাজগঞ্জ : যমুনা নদীর পানি সিরাজগঞ্জে কমতে শুরু করেছে। পানি কমলেও মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে। বর্তমানে যমুনার পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি কমলেও এখনো প্রায় ২৮ হাজার পরিবার পানিবন্দি রয়েছে। পানি নামায় বিধ্বস্ত বসতবাড়ি দেখে হাপিত্যেশ করছে বন্যাকবলিতরা। ঘরের নিম্নাংশ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সংস্কার নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। পানি কমায় খেতের নষ্ট হওয়া ফসল দেখে চোখমুখে দুশ্চিন্তায় ছাপ পড়েছে কৃষকদের। বন্যাকবলিতদের বর্তমানে কাজকর্ম না থাকায় খাদ্য সংকটও দেখা দিয়েছ। শিশুখাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটছে। অন্যদিকে পানি কমতে থাকায় শাহজাদপুর, এনায়েতপুর ও চৌহালীতে নদীতীরে ভাঙন শুরু হয়েছে। প্রতিদিন ফসলি জমিসহ বসতভিটা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে বন্যাকবলিতরা চরম দুর্বিষহ অবস্থায় জীবনযাপন করছে।

বগুড়া : বগুড়ায় যমুনা নদীর পানি কমে বিপৎসীমার ২৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ সংবাদে বাঁধে আশ্রিতরা বাড়ি ফেরার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। পানিবন্দি বানভাসিদের মাঝে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। নদী এলাকায় পানি কমতে থাকায় গ্রামের রাস্তাঘাট খানাখন্দকে ভরে উঠেছে। আবার কোথাও কোথাও রাস্তার সীমানা হারিয়ে গেছে। পানিতে তলিয়ে থাকা ফসলে পচন ধরেছে।

নীলফামারী : নীলফামারীতে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরেছে তিস্তা। গত দুই দিন ধরে নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় স্বস্তি ফিরেছে বন্যাকবলিত মানুষের মধ্যে। এমন স্বাভাবিকতায় বিভিন্ন স্থানে আশ্রিত পরিবারগুলো ফিরেছে নিজ নিজ বাড়িতে। গতকাল বিকাল ৩টায় ডালিয়ায় তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে নদীর পানি বিপৎসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। এর আগে গত বৃহস্পতিবার সেখানে পানিপ্রবাহ ছিল বিপৎসীমার ৬০ সেন্টিমিটার নিচে। পয়েন্টটিতে পানির বিপৎসীমা ৫২ দশমিক ৬০ সেন্টিমিটার।

রংপুর : বন্যাদুর্গত এলাকার জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে রংপুর বিভাগে ৭০৪টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। এসব টিম বন্যায় দুর্গত প্রতিটি এলাকায় অবস্থান করে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেটসহ নানা ধরনের ওষুধসামগ্রী বিনামূল্যে সরবরাহ করছে।

নেত্রকোনা : পাহাড়ি ঢলে নেত্রকোনা জেলার ১০ উপজেলা প্লাবিত হলেও সবচেয়ে বেশি প্লাবিত হয়েছে ৭৭টি ইউনিয়ন। গত এক সপ্তাহ ধরে পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সাড়ে পাঁচ লাখে। এমন অবস্থায় জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় উদ্ধারে কাজ করে যাচ্ছে। পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠন জনপ্রতিনিধিরাও দিচ্ছে ত্রাণ সহায়তা। সরকারি হিসাব অনুযায়ী বন্যার পানিতে ডুবে চারজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলেও বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত ৫ জনের খবর পাওয়া গেছে। এদিকে কলমাকান্দায় ডায়রিয়ায় মারা গেছেন একজন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া : বিজয়নগর উপজেলার ১০ ইউনিয়নের ৩৫টি গ্রাম মানুষ বন্যাকবলিত হয়েছেন। উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, তিতাস নদীর নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় উপজেলার দত্তখোলা, এক্তারপুর, সহদেবপুর, চর-ইসলামপুর, মনিপুর, পত্তন, গোয়ালখলা, লক্ষ্মীমোড়া, চান্দুরা, কালিসিমা, চম্পকনগরের ভাটি এলাকাসহ উপজেলার ২০টি গ্রামে পানি ঢুকেছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ১৭০০ পরিবারের প্রায় সাড়ে ৮ হাজার মানুষ। বানভাসি মানুষের অভিযোগ, এক সপ্তাহ ধরে তারা দুর্ভোগের শিকার হলেও এখন পর্যন্ত সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা পাননি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর