রবিবার, ১৪ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা
সংবাদ সম্মেলনে বাজুস

সোনা চোরাচালানে পাচার ৭৩ হাজার কোটি টাকা

♦ সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি পাইকারি বাজার ♦ শৃঙ্খলা আনতে কঠোর অভিযানের বিকল্প নেই ♦ কড়া গোয়েন্দা নজরদারি ও জব্দ সোনার ২৫% পুরস্কারের দাবি

বিশেষ প্রতিনিধি

সারা দেশের জল, স্থল ও আকাশ পথে প্রতি বছর সোনা চোরাচালানের মাধ্যমে প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা পাচার হয় বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস)। সংগঠনটি বলেছে, পোদ্দার সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি সোনার পাইকারি বাজার। ফলে জুয়েলারি শিল্পে শৃঙ্খলা আনতে কঠোর অভিযানের বিকল্প নেই। প্রয়োজন কড়া গোয়েন্দা নজরদারি। চোরাচালানে জব্দ হওয়া সোনার ২৫ শতাংশ কাস্টমসসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সদস্যদের পুরস্কার হিসেবে প্রদান করতে হবে। পাশাপাশি সারা দেশে নিম্নমানের সোনা ও ডায়মন্ডের অলংকার তৈরি এবং বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোয় সরকারের সহায়তা নিয়ে অভিযান পরিচালনার ঘোষণা দিয়েছে বাজুস।

গতকাল রাজধানীর বসুন্ধরা সিটিতে সংগঠনটির কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া লিখিত বক্তব্যে এসব কথা বলেন বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন অ্যান্টি স্মাগলিং অ্যান্ড ল এনফোর্সমেন্টের চেয়ারম্যান এনামুল হক খান দোলন। এতে উপস্থিত ছিলেন বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন অ্যান্টি স্মাগলিং অ্যান্ড ল এনফোর্সমেন্টের ভাইস চেয়ারম্যান বিধান মালাকার, সদস্যসচিব ইকবাল উদ্দিন, কমিটির সদস্য স্বপন চন্দ্র কর্মকার, বিকাশ ঘোষ ও বাবুল রহমান। সারা দেশে জুয়েলারি শিল্পের চলমান সংকট ও সমস্যা, দেশি-বিদেশি চোরাকারবারি সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য, অর্থ পাচার ও চোরাচালান বন্ধে কাস্টমসসহ সব আইন প্রয়োগকারী সংস্থার জোরালো অভিযানের দাবিতে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে দেশের ঐতিহ্যবাহী বাণিজ্য সংগঠন বাজুস। সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া লিখিত বক্তব্যে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ও বিশ্লেষণ তুলে ধরে এনামুল হক খান দোলন বলেন, বাজুসের প্রাথমিক ধারণা অনুযায়ী প্রবাসী শ্রমিকদের রক্ত-ঘামে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার অপব্যবহার করে প্রতিদিন সারা দেশের জল, স্থল ও আকাশ পথে কমপক্ষে প্রায় ২০০ কোটি টাকার অবৈধ সোনার অলংকার ও বার চোরাচালানের মাধ্যমে বাংলাদেশে আসছে, যা ৩৬৫ দিন বা এক বছর শেষে দাঁড়ায় প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা। দেশে চলমান ডলার সংকটে এ ৭৩ হাজার কোটি টাকার অর্থ পাচার ও চোরাচালান বন্ধে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি সরকারের উদ্যোগ প্রসঙ্গে বাজুসের প্রস্তাব তুলে ধরে বলেন, সোনা চোরাকারবারিদের চিহ্নিত করতে বাজুসকে সম্পৃক্ত করে পৃথকভাবে সরকারি মনিটরিং সেল গঠন করতে হবে। পাশাপাশি চোরাকারবারিদের দমনে প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে আরও কঠোর আইন করতে হবে। এ ছাড়া ব্যাগেজ রুলের আওতায় সোনার বার ও অলংকার আনার সুবিধা অপব্যবহারের কারণে ডলার সংকট ও চোরাচালানে কী প্রভাব পড়ছে, তা জানতে বাজুসকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) সমীক্ষা পরিচালনার প্রস্তাব দিয়েছে সংগঠনটি।

বাজুসের সাবেক এই সভাপতি সোনার বাজারে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতির প্রভাব প্রসঙ্গে বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়ার চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতি পুরো বিশ্ব অর্থনীতিকে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দিয়েছে। ফলে বিশ্বব্যাপী পণ্যমূল্য বেড়েছে। মূল্যস্ফীতির চরম আঘাতে বিশে^র বিভিন্ন দেশ বিপর্যস্ত। দেশে দেশে মার্কিন ডলারসহ অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রার দাম প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এরই প্রভাব পড়েছে সোনার বিশ্ববাজারে। এনামুল হক খান দোলন বৈদেশিক মুদ্রা ও চোরাচালান সংকট তুলে ধরে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে অব্যাহতভাবে মার্কিন ডলারের মাত্রাতিরিক্ত দাম ও সংকটসহ অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রার ঊর্ধ্বমুখী দাম এবং বেপরোয়া চোরাচালানের ফলে বহুমুখী সংকটে পড়েছে দেশের জুয়েলারি শিল্প। দেশে ডলারের দাম ১১৮ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। এমন পরিস্থিতিতে সোনার বাজারে অস্থিরতা ছড়িয়ে দিয়েছে চোরাকারবারিদের দেশি-বিদেশি সিন্ডিকেট। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে প্রতিনিয়ত স্থানীয় পোদ্দার বা বুলিয়ন বাজারে সোনার দাম বাড়ানো হচ্ছে। পোদ্দারদের সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে সোনার পাইকারি বাজার। পোদ্দারদের সঙ্গে চোরাকারবারিদের সিন্ডিকেটের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। মূলত এ চোরাকারবারিদের একাধিক সিন্ডিকেট বিদেশে সোনা পাচারের সঙ্গে জড়িত বলে মনে করা হয়। দেশে চলমান ডলার সংকট ও অর্থ পাচারের সঙ্গে সোনা চোরাচালানের সিন্ডিকেটগুলোর সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। এমন পরিস্থিতিতে সোনার বাজারে অস্থিরতার নেপথ্যে জড়িত চোরাকারবারিদের বিরুদ্ধে কাস্টমসসহ দেশের সব আইন প্রয়োগকারী সংস্থার জোরালো অভিযান এবং দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সোনার বাজারে শৃঙ্খলা আনতে কঠোর অভিযানের বিকল্প নেই।

বাজুসের এই নেতা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর প্রশংসা করে বলেন, সারা দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা ও সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা ও ব্যবসায়িক সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। কোনো দুষ্কৃতকারী, চোরাকারবারি যাতে দেশবিরোধী ও অবৈধ কার্যক্রম পরিচালনা করতে না পারে সে লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করে আসছে। অনেক চোরাকারবারিকে আইনের মুখোমুখি করা হয়েছে। এতে সরকারের রাজস্ব বাড়ছে। অবৈধ উপায়ে কোনো চোরাকারবারি যেন সোনা বা অলংকার দেশে আনতে এবং বিদেশে পাচার করতে না পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা সরকারের সব সংস্থাকে প্রদানের জন্য সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করা হয়েছে। বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন অ্যান্টি স্মাগলিং অ্যান্ড ল এনফোর্সমেন্টের চেয়ারম্যান চোরাচালান প্রতিরোধে সংগঠনটির প্রস্তাব তুলে ধরে বলেন, ‘আমাদের ধারণা, দেশে অবৈধভাবে আসা সোনার সিকিভাগও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নজরে আসছে না। ফলে নিরাপদে দেশে আসছে চোরাচালানের বিপুল পরিমাণ সোনা। আবার একইভাবে পাচার হচ্ছে। বাংলাদেশ যে সোনা চোরাচালানের রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, এটা কথার কথা নয়। প্রতিষ্ঠিত সত্য। এ পরিস্থিতি উত্তরণে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নিয়মিত কড়া নজরদারি প্রয়োজন। পাশাপাশি বাজুসকে সম্পৃক্ত করে আইন প্রয়োগকারী সব দফতরের সমন্বয়ে সোনা চোরাচালানবিরোধী সেল গঠন করতে হবে। এ ছাড়া চোরাচালান প্রতিরোধ করতে গিয়ে উদ্ধার হওয়া সোনার মোট পরিমাণের ২৫ শতাংশ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সদস্যদের পুরস্কার হিসেবে প্রদানের অনুরোধ করছি। মূলত চোরাচালান প্রতিরোধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সদস্যদের উৎসাহিত করার লক্ষ্যে বাজুসের এ প্রস্তাব। বাজুসের এ প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে সোনা চোরাচালান প্রতিরোধ কার্যক্রম আরও বেগবান হবে। ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অপচয় কমবে।’

বাজুসের এই সাবেক সভাপতি জুয়েলারি শিল্পের চলমান সংকট মোকাবিলায় করণীয় তুলে ধরে বলেন, ‘গয়নার মান উন্নয়নে হলমার্ক নীতিমালা ও ডায়মন্ড নীতিমালা প্রণয়নে সরকারের কাছে জোরালো দাবি জানাচ্ছি। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে বাজুস।’ সোনা ও ডায়মন্ডের অবৈধ এবং অসাধু জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানের মালিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, হলমার্ক ছাড়া কোনো অলংকার বিক্রি করা যাবে না। যদি কোনো জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানে হলমার্ককৃত অলংকার নিম্নমানের পাওয়া যায় তাহলে যে প্রতিষ্ঠান ওই অলংকার হলমার্ক করেছে সে প্রতিষ্ঠানকে অভিযুক্ত করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে অবহিত করবে বাজুস। এনামুল হক খান দোলন বলেন, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী সারা দেশে সোনার চারটি মান রয়েছে- যথাক্রমে ১৮, ২১, ২২ ও ২৪ (৯৯ দশমিক ৫)। এ মানের নিচে কোনো সোনা বা স্বর্ণালংকার বিক্রি করা যাবে না। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, তেজাবি (পাকা সোনা বা পিওর গোল্ড) সোনার ক্ষেত্রে কোনো অবস্থাতেই ৯৯ দশমিক ৫-এর নিচে মান গ্রহণযোগ্য নয়। এ ক্ষেত্রে সব হলমার্কিং কোম্পানিকে সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী সোনা পরীক্ষা করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো।

 

সর্বশেষ খবর