যে দেশে সেচের অভাবে ধানের চারা বাঁচাতে না পেরে অভিনাথ মারানডি ও রবি মারানডির মতো কৃষকরা আত্মহত্যা করেন, সেই দেশে প্রতি বছর নষ্ট বা অপচয় হচ্ছে ৮০ লাখ ৮৬ হাজার টনের বেশি চাল। চিকন ও মোটা চাল মিলিয়ে গড়ে প্রতি কেজি ৫০ টাকা ধরলে যার মূল্য দাঁড়ায় ৪০ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। অন্যদিকে হিসাবের খাতায় চাল উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও প্রতি বছর গড়ে ৩০-৩৫ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানি করতে হচ্ছে। এতে ব্যয় মেটাতে হচ্ছে ১০০ কোটি ডলারের বেশি।
কৃষি বিভাগের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে বছরে চাল উৎপাদন হয় প্রায় ৩ কোটি ৮৬ লাখ মেট্রিক টন। এর থেকে মানুষের খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয় আড়াই কোটি মেট্রিক টনের মতো। বাকিটা বীজ, পশুখাদ্যসহ অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত হয়। চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি হলেও দেশে চালের বাজার সব সময়ই অস্থির। বর্তমানে ১ কেজি মোটা চাল কিনতেই দেশের মানুষকে গুনতে হচ্ছে ৫৫-৬০ টাকা। চিকন চালের দাম ৮০-৮৫ টাকা কেজি। সেখানে শুধু ব্যবস্থাপনা ত্রুটির (কর্তন, মাড়াই, পরিবহন, গুদামজাতকরণ প্রভৃতি) কারণে বছরে নষ্ট হচ্ছে ৬৭ লাখ মেট্রিক টন চাল। গৃহস্থালি পর্যায়ে অপচয় হচ্ছে আরও ১৩ লাখ ৮৬ হাজার টন, যার মধ্যে খাবার টেবিলেই অপচয় হচ্ছে অন্তত ৬ লাখ ৩০ হাজার টন চাল। শুধু খাবার টেবিলের অপচয় রোধ হলেই ৪২ লাখ ৬২ হাজার মানুষের সারা বছরের ভাতের চাহিদা মিটত। ফলন পার্থক্য আন্তর্জাতিক মানে নামিয়ে আনতে পারলে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে চাল আমদানির প্রয়োজন পড়ত না, উল্টো রপ্তানি হতো।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট-ব্রির ‘ডাবলিং রাইস প্রোডাক্টিভিটি ইন বাংলাদেশ : অ্যা ওয়ে টু অ্যাচিভিং এসডিজি ২ অ্যান্ড মুভিং ফরোয়ার্ড’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১১-১৬ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে শুধু উৎপাদন পর্যায়েই ধানের গড় ফলন নষ্ট হয়েছে ২০ দশমিক ৬৭ শতাংশ। ২০১৬-২০ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে নষ্ট হয়েছে ১৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, ২০১৫-১৬ থেকে ২০১৯-২০ পর্যন্ত পাঁচ বছরে দেশে মোট ১৭ কোটি ৭৮ লাখ টন চাল উৎপাদন হয়েছে। পাঁচ বছরে চাল উৎপাদনের বার্ষিক গড় পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ৫৬ লাখ টন। ১৮.৮৩ শতাংশ হারে চাল নষ্ট হলে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৬৭ লাখ টন চাল থেকে বঞ্চিত হয়েছে বাংলাদেশ। এখানেই শেষ নয়। ব্রির গবেষণা অনুযায়ী, উৎপাদিত চালের একটা অংশ হিউম্যান কনজাম্পশন বা মানুষ খাবার হিসেবে ব্যবহার করে। আরেকটি অংশ নন-হিউম্যান (বীজ, পশুখাদ্যসহ অন্যান্য) কনজাম্পশন। হিউম্যান কনজাম্পশনের ৫.৫ শতাংশ আবার গৃহস্থালি পর্যায়ে অপচয় হয়, যার পরিমাণ অন্তত ১৩ লাখ ৮৬ হাজার টন। এর মধ্যে খাদ্য সংগ্রহ ও প্রস্তুতি (চাল ধোয়া, রান্না ইত্যাদি) পর্যায়ে ৩ শতাংশ বা ৭ লাখ ৫৬ হাজার টন এবং পরিবেশন ও প্লেট পর্যায়ে ২.৫ শতাংশ বা ৬ লাখ ৩০ হাজার টন অপচয় হয়। সরকারি হিসাবে জনপ্রতি দৈনিক চালের ভোগ ৪০৫ গ্রাম। সেই হিসাবে গৃহস্থালি পর্যায়ের অপচয় রোধ হলে প্রায় ৯৪ লাখ মানুষের সারা বছরের ভাতের চাহিদা পূরণ হতো। এ ব্যাপারে ব্রির মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্ব) ড. মো. শাহজাহান কবীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ধানের ফলনের স্ট্যান্ডার্ড অপচয় ধরা হয় ৫-৭ শতাংশ। চীন ও জাপানে ফলন পার্থক্য ৫ শতাংশের কাছাকাছি। আমাদের দেশে ফলন নষ্টের পরিমাণ ৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারলে কমপক্ষে ৫০ লাখ টন বাড়তি চাল পেতাম। এ ছাড়া আমরা বিলাসিতা করে বিয়ে-শাদির অনুষ্ঠানে, রেস্টুরেন্টে, খাবার প্লেটে প্রচুর অপচয় করি। শুধু ভাত নয়, অন্য খাবারও অপচয় করি। যে দীর্ঘ পরিভ্রমণ ও পরিশ্রমের মাধ্যমে একটি শস্যদানা খাবার টেবিল পর্যন্ত পৌঁছায়, সেই উপলব্ধি থাকলে কেউ খাবার নষ্ট করত না। আমরা বছরে ২ কোটি ৫২ লাখ টন চাল খাবার হিসেবে গ্রহণ করি। এই চালের ৫.৫ শতাংশ অসচেতনতা ও বিলাসিতার কারণে গৃহস্থালি পর্যায়ে অপচয় হয়। এই খাবারগুলো দিয়ে কত মানুষের আহার হতো সেটা ভাবা উচিত। আমার আছে বলে আমি অপচয় করব, এটা ঠিক নয়। তিনি বলেন, উৎপাদন পর্যায়ে ধানের ফলন পার্থক্য কমিয়ে আনতে ব্রি মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। কম্বাইন্ড হারভেস্ট শুরু হওয়ায় অপচয় কমেছে। আগে যেখানে ১৮-১৯ শতাংশ ক্ষতি হতো, সেটা এখন ১০-১২ শতাংশ হবে বলে ধারণা করছি। কিছুদিনের মধ্যেই নতুন গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করব। তিনি বলেন, গুদামজাতে চালের বড় ক্ষতি হয়। ইঁদুর, আবহাওয়া, পোকার কারণেও ক্ষতি হয়। সরকারি গুদামগুলো পুরাতন। আধুনিকায়ন প্রয়োজন। এদিকে ব্রির গবেষণাটি দেশে ১৭ কোটির বেশি মানুষ ধরে হিসাব করা হলেও চলতি বছরের জনশুমারি অনুযায়ী জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন। সেই অনুযায়ী চালের প্রকৃত চাহিদা আরও কম হওয়ার কথা। দেশের মানুষ ভাত খাওয়া বাড়িয়ে দিয়ে না থাকলে চালের প্রকৃত অপচয় আরও বেশি অথবা প্রকৃত উৎপাদন হিসাবের চেয়ে কম।
 
                         
                                     
                                                             
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        