শনিবার, ২৭ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

ঢাবির শিক্ষার্থী হওয়ার সাধেই ক্লাস করছিলেন সাজিদ!

নাসিমুল হুদা, ঢাবি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হলে ভর্তি পরীক্ষার গণ্ডি পার হতেই হবে। সান্ধ্য কোর্সে ভর্তি হয়েও ক্লাস করার সুযোগ আছে। কিন্তু ‘অরিজিনাল ঢাবিয়ান’ হওয়ার গৌরব ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে আসা শিক্ষার্থীরাই উপভোগ করেন। স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার গৌরবই হয়তো আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলেন সাজিদুল কবির। তাই তো সাড়ে তিন বছর আরেক শিক্ষার্থীর রোল ব্যবহার করে ক্লাস করে গেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এতদিনেও তার শিক্ষক বা সহপাঠীদের কেউই তাকে ‘ঢাবি’র শিক্ষার্থী নয়’ বলে শনাক্ত করতে পারেনি। সর্বশেষ গত ২৪ আগস্ট একটি মিড-টার্ম পরীক্ষায় অংশ নিতে গিয়ে প্রকৃত পরিচয় বেরিয়ে পড়ে সাজিদের।

যথারীতি প্রক্টরের দফতর হয়ে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হয়েছে সাজিদকে। তবে অসৎ কোনো উদ্দেশ্য না থাকায় মুচলেকা নিয়ে তাকে বাবা-মায়ের জিম্মায় দিয়েছে পুলিশ। সংশ্লিষ্ট বিভাগের শিক্ষকরাও এটাকে মানবিক দৃষ্টিতেই দেখছেন।

ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ১৩ আগস্ট প্রকাশিত রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের পঞ্চম সেমিস্টারের একটি কোর্সের সেশনাল ফলাফলে বিভাগ ছেড়ে চলে যাওয়া একজন শিক্ষার্থীর ফলাফল দেখা যায়। তখনই ওই বর্ষের শিক্ষার্থীদের মনে হতে থাকে, কেউ একজন অন্যের নামে পরীক্ষা দিচ্ছে। এরপর ২১ আগস্ট আরেকটি পরীক্ষায় ভিন্ন নামে একটি খাতা শনাক্ত করা যায়, যিনি অনেক দিন আগেই বিভাগ ছেড়ে চলে গেছেন। পরে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি ও শিক্ষকদের সহায়তার হাজিরা খাতা দেখে ওই খাতায় পরীক্ষা দেওয়া সাজিদকে চিহ্নিত করা হয়। সর্বশেষ ২৪ আগস্ট পরীক্ষা দিতে এলে তাকে ধরা হয়, পরবর্তী সময়ে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে তিনি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নন, তা প্রমাণিত হয়। পরে তাকে পুলিশের হেফাজতে দেওয়া হয়।

সংশ্লিষ্ট শিক্ষক ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাজিদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার তীব্র ইচ্ছা ছিল। তিনি এসএসসিতে জিপিএ-৫ এবং এইচএসসিতে ৪ দশমিক আটের ওপরে জিপিএ পেয়েছিলেন। ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ হয়নি। তবে ঢাকায় আসা-যাওয়ার সূত্রে বিভাগের ক্লাস করার সুযোগ নিয়ে নেন তিনি।

তবে এতদিন কীভাবে নিজের প্রকৃত পরিচয় গোপন করা সম্ভব হয়েছে সাজিদের পক্ষে, এ ব্যাপারে বিভাগের সংশ্লিষ্টরা জানান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে প্রতিটি বর্ষে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২২০-এর মতো। অনেক ক্ষেত্রে সহপাঠীরাই সবাইকে চিনতে পারেন না। ফলে কোনো শিক্ষার্থী বিভাগ থেকে (অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংবা বিদেশে) চলে গেলেও সবাই তা খেয়াল করতে পারেন না। এই সুযোগেই সাজিদ চলে যাওয়া শিক্ষার্থীদের রোল ব্যবহার করে নিজের তথ্য গোপন করতে পেরেছেন। বিভাগের স্বাভাবিক কার্যক্রমে তার শনাক্ত হওয়ার ভয় ছিল না। করোনার দীর্ঘ বন্ধও তাকে সুবিধা দিয়েছিল। অন্যদিকে, সেমিস্টার সমাপনী পরীক্ষার যাচাই-বাছাইয়ে শনাক্ত হওয়ার সুযোগ ছিল, কিন্তু সাজিদ কখনো এসব পরীক্ষায় অংশই নেননি। বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাজিদ একাধিক সহপাঠীর সঙ্গে ক্লাসে অংশ নেওয়া, পরীক্ষার জন্য শিট সংগ্রহ, খেতে যাওয়া ও ব্যাচ ডে প্রভৃতিতে অংশ নিয়েছিলেন। ফলে কোনোভাবেই তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নন বলে মনে হওয়ার কারণ ছিল না। তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে সংযুক্ত পরিচয় দিলেও হলে না থাকায় সেখানেও শনাক্ত হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। 

তবে সাজিদের ক্লাস করার বিষয়টিকে মানবিকভাবেই দেখছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকী। এমনকি সাজিদের জ্ঞানার্জনের ইচ্ছাকেও ইতিবাচক দেখছেন তিনি। অধ্যাপক সিদ্দিকী বলেন,  সে আমার ক্লাসও করেছে। আমিও তাকে পছন্দ করি, সে ক্লাসে কখনো বেয়াদবি করেনি। সে ক্লাস করেছে, জ্ঞানার্জন করেছে, চলে গেছে। সে তো কোনো অন্যায় করেনি। সে ফাইনাল পরীক্ষাও দেয়নি যে কারও রেজাল্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার মানসিক একটা বাধ্যবাধকতা ছিল-আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব। সেই জায়গা থেকে সে এই কাজটা করেছে। বিভাগে অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থী থাকায় ধরে ধরে সবাইকে শনাক্ত করা সম্ভব নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তবে কেউ যাতে রেজিস্ট্রার অফিসে কারসাজি করে অন্য একজনের পরিচয় ব্যবহার করে ছাত্রত্ব অর্জন করতে না পারে, এ ব্যাপারে সাবধান হওয়ার কথা বলেন তিনি। গণমাধ্যমে সাজিদের ছবি প্রকাশের সমালোচনাও করেন এই শিক্ষক।

শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মওদুত হাওলাদার বলেন, সাজিদের এলাকাতেও খবর নেওয়া হয়েছে। ছেলেটি ভালো, টিউশনি করায়। বর্তমানে বিদেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তার কোনো অসৎ উদ্দেশ্য ছিল, এরকম আমরা পাইনি। ফলে মুচলেকা নিয়ে বাবা-মায়ের জিম্মায় দিয়ে দেওয়া হয়েছে।

 

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর