শনিবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

ভুয়া ডাক্তারে সর্বনাশ

মৃত্যুদূত হয়ে ঘুরছে অসংখ্য ভুয়া ডাক্তার

শামীম আহমেদ

ভুয়া ডাক্তারে সর্বনাশ

মৃত্যুদূত হয়ে চারপাশে ঘুরছে অসংখ্য ভুয়া চিকিৎসক। ফার্মেসিতে বা চিকিৎসকের সহকারী হিসেবে কিছুদিন কাজ করেই বনে যাচ্ছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। নামের সঙ্গে বড় বড় ডিগ্রি লাগিয়ে অপরিচিত এলাকায় গিয়ে খুলে বসছেন চেম্বার। কেউ মৃত ডাক্তারের নামে প্যাড ছাপিয়ে চালাচ্ছেন চিকিৎসা কার্যক্রম। কেউ আবার জীবিত চিকিৎসকের নাম ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর ব্যবহার করে ভিন্ন এলাকায় গিয়ে উচ্চবেতনে চাকরি নিচ্ছেন বেসরকারি ক্লিনিকে। জাল সার্টিফিকেট দিয়ে মিলে যাচ্ছে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সদস্যপদ। মোটা অঙ্কের ফি দিয়ে এসব চিকিৎসকের কাছে গিয়ে রোগ তো ভালো হচ্ছেই না, অকালে প্রাণ পর্যন্ত হারাচ্ছেন অনেকে। স্বাস্থ্য বিভাগের তদারকির অভাবে ক্রমেই এসব ভুয়া চিকিৎসকে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে দেশ। তারা খেলছেন মানুষের জীবন নিয়ে।

ঘটনা- : করিম লোহানী অন্যের সার্টিফিকেটে নিজের ছবি লাগিয়ে তৈরি করেছিলেন এমবিবিএস পাসের সার্টিফিকেট। এ নকল সার্টিফিকেট দেখিয়েই চিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে আসছিলেন ৩২ বছর ধরে। গেল ২৯ আগস্ট একটি সিজারিয়ান অপারেশনে নবজাতক মারা গেলে শুরু হয় হইচই। খবর পেয়ে হাজির হন স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা। সার্টিফিকেট যাচাইয়ে বেরিয়ে আসে আসল ঘটনা। ঘটনাটি ঘটে নাটোরের বড়াইগ্রামে একটি বেসরকারি ক্লিনিকে। পরে জানা যায়, একই অপরাধে ২০১৯ সালে রাজশাহীতে আটক হয়ে তিন মাস জেল খেটেছিলেন এই ভুয়া চিকিৎসক।

ঘটনা- : এফ এম শাহ সেকেন্দার নিজেকে পরিচয় দিতেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের বিভাগীয় প্রধান ও বিসিএস ক্যাডারের চিকিৎসক। ভিজিটিং কার্ডে দেশ-বিদেশের অনেক ডিগ্রি। পাঁচ মাস ধরে ‘টাঙ্গাইল ক্লিনিক অ্যান্ড হসপিটালে’ রোগী দেখছিলেন। ভুল চিকিৎসার অভিযোগ উঠলে ২০১৯ সালের এপ্রিলে তাকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ফার্মেসিতে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে চিকিৎসক সেজে প্রতারণা শুরু করেন তিনি।

ঘটনা- : বাগেরহাটের প্রয়াত চিকিৎসক আকরাম হোসেন দিদারের সার্টিফিকেট নকল করে ‘চিকিৎসাসেবা’ দিয়ে আসছিলেন সিরাজগঞ্জের এসএসসি পাস আক্তারুজ্জামান। এক সার্জনের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন কিছুদিন। এরপর নিজেই বনে যান বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। ডা. দিদারের মুখে দাড়ি থাকায় আক্তারুজ্জামানও দাড়ি রাখেন। বাগেরহাট, মাদারীপুর, চাঁদপুর, গাজীপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় হাসপাতাল ও ক্লিনিকে রোগী দেখেছেন। মাদারীপুরে তার হাতে শিশু মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে। ভুয়া চিকিৎসক হিসেবে গ্রেফতার হয়ে ছয় মাস কারাভোগও করেন। বের হয়ে আবারও একই প্রতারণায় লিপ্ত হন। ২০১৯ সালে তাকে গাজীপুরের ‘আপন ডায়াগনস্টিক সেন্টার’ থেকে আবারও গ্রেফতার করে র‌্যাব। এমন অসংখ্য ভুয়া চিকিৎসক সারা দেশ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন।

ভুয়া সার্টিফিকেট দাখিল করে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) থেকে রেজিস্ট্রেশনও নিচ্ছেন অনেকে। মোহাম্মদ ওয়াহিদুজ্জামান ও দীনেশচন্দ্র দেবনাথ ভুয়া সার্টিফিকেট দিয়ে বিএমডিসি রেজিস্ট্রেশন নেন ২০০৬ সালে। ১৫ বছর পর ২০২১ সালে তাদের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে মামলা করে বিএমডিসি। একইভাবে সুনামগঞ্জের মোহাম্মদ কবির হোসাইন ২০১১ সালে ও চাঁদপুরের মোহাম্মদ ওমর ফারুক ২০১৭ সালে ভুয়া সার্টিফিকেট দাখিল করে রেজিস্টেশন নেন। ২০২০ সালে কবিরের ও ২০১৯ সালে ফারুকের রেজিস্ট্রেশন বাতিল হয়।

এদিকে ভুয়া ডাক্তার, হয়রানি, ভুল চিকিৎসা, ডায়াগনস্টিক রিপোর্টসহ নানা কারণে দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারিয়ে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ চিকিৎসার জন্য পাড়ি দিচ্ছেন বিদেশে। এ আস্থা হারানোদের তালিকায় রয়েছেন মন্ত্রী, এমপি, আমলা, রাজনীতিবিদ। বাংলাদেশ আউটবাউন্ড ট্যুর অপারেটরস ফোরামের (বিওটিওএফ) তথ্যমতে, প্রতি বছর গড়ে ৮ লাখ মানুষ বিদেশে চিকিৎসা নিতে যান। ২০২০ সালে পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক জরিপে দেখা যায়, দেশের মানুষ এক বছরে বিদেশযাত্রায় ব্যয় করেছেন ৩৩ হাজার ৬৮৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে চিকিৎসা খাতে। বিওটিওএফের হিসাবে প্রতি বছর বিদেশে বাংলাদেশিদের চিকিৎসা নিতে খরচ হচ্ছে অন্তত ৪০০ কোটি ডলার। অথচ সংকটকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ আইএমএফ থেকে ঋণ চেয়েছে ৪৫০ কোটি ডলার, যার জন্য নানা শর্ত জুড়ে দিয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি।

গাইনি চিকিৎসক ডা. মো. তৌফিকুর রহমান (রেজি. ৪৬১২২) বলেন, ‘ভুয়া চিকিৎসকরা নামের পেছনে পিজিটি, বিএইচএস, এফসিপিএস (পার্ট-১), (পার্ট-২), এমডি (ইনকোর্স) (পার্ট-১), (পার্ট-২), (থিসিস পর্ব) (লাস্ট পার্ট), কোর্স কমপ্লিটেড (সিসি), এম (ইনকোর্স) (পার্ট-১), (পার্ট-২) ইত্যাদি এবং দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ফেলোশিপ ও প্রশিক্ষণ যেমন এফআরসিপি, এফআরএইচএস, এফআইসিএ, এফআইসিএস, এফএএমএস, এফআইএজিপি ইত্যাদি উল্লেখ করছেন। এগুলো স্বীকৃত শিক্ষাগত যোগ্যতা নয় এবং বিএমডিসি থেকে স্বীকৃত নয়। এগুলো লেখার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞাও আছে। এগুলো দেখে রোগী আমাদের কাছে না এসে বড় ডাক্তার মনে করে তাদের কাছে গিয়ে প্রতারিত হচ্ছেন। রোগ ভালো হওয়া দূরের কথা, অনেক রোগী মারাও যাচ্ছেন। এতে দেশের চিকিৎসা পেশার দুর্নাম হচ্ছে।’

এদিকে মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে দু-এক জন ভুয়া চিকিৎসক আটক হলেও তিন মাস, ছয় মাস জেল খেটে বেরিয়ে আবারও একই কাজে লিপ্ত হচ্ছেন। প্রতারণা ঠেকাতে বিএমডিসি একাধিকবার চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রে ও সাইনবোর্ডে রেজিস্ট্রেশন নম্বর লেখার নির্দেশনা দিলেও মানছেন না অনেকেই। এ ব্যাপারে বিএমডিসির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মাহমুদ হাসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘রেজিস্টার্ড চিকিৎসকদের ছবিসহ তালিকা আমাদের ওয়েবসাইটে (http://bmdc.org.bd/) দেওয়া আছে। রোগী চাইলেই রেজিস্ট্রেশন নম্বর দিয়ে চিকিৎসক ভুয়া কি না যাচাই করতে পারেন। তবে রোগীরা তা করেন না। বিএমডিসি সনদ ছাড়া চিকিৎসা কার্যক্রম চালানো দণ্ডনীয় অপরাধ। ভুয়া ডাক্তারের কারণে পেশার ক্ষতি হচ্ছে। তবে এ ব্যাপারে অভিযান চালানোর আইনি ক্ষমতা বিএমডিসির নেই। জেলা সিভিল সার্জন বা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে জানালে তাঁরা প্রশাসনের সহযোগিতায় ব্যবস্থা নিতে পারেন। এ ছাড়া বিএমডিসি থেকে একাধিকবার চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্রে ও সাইনবোর্ডে রেজিস্ট্রেশন নম্বর উল্লেখ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অনেকে মানছেন না। এটা নিয়মবহির্ভূত। এ ব্যাপারে চিকিৎসকদের সচেতন হওয়া উচিত। ব্যবস্থাপত্রে রেজিস্ট্রেশন নম্বর না থাকলে চিকিৎসককে প্রশ্ন করতে পারেন, অভিযোগ দিতে পারেন। বিএমডিসির আইনশৃঙ্খলা কমিটি সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।’ এদিকে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ওয়েবসাইটের মাধ্যমে চিকিৎসক যাচাই করার পন্থা অধিকাংশ রোগীই জানেন না। তালিকাটি নিয়মিত হালনাগাদ না করায় অনেক চিকিৎসকের পরিচয় নেই। আবার চিকিৎসকের বয়স ৭০ বছর হয়ে গেলেও ছবি দেওয়া আছে ২৫-৩০ বছর বয়সের। ফলে ছবি দেখে চেনা দুষ্কর।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর