বৃহস্পতিবার, ২০ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

সংকটে শিশু হৃদরোগ চিকিৎসা

জয়শ্রী ভাদুড়ী

সংকটে শিশু হৃদরোগ চিকিৎসা

জন্মগত হৃদরোগে ভুগছে ছয় মাস বয়সী শিশু জুবায়ের আলী। রোগ শনাক্তের পর জরুরি ভিত্তিতে হার্টের সার্জারির কথা বলেছেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন ও রিসার্চ ইনস্টিটিউটের শিশু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ। একমাত্র সন্তানকে বাঁচাতে সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা জোগাড় করেছে জুবায়েরের পরিবার। কিন্তু এক মাস অপেক্ষায় থাকার পর মিলেছে অপারেশনের সিরিয়াল। কারণ হার্ট ফাউন্ডেশনে সার্জারির অপেক্ষায় থাকা কয়েক শ শিশু হৃদরোগীর বিপরীতে পেডিয়াট্রিক কার্ডিয়াক সার্জন আছেন মাত্র দুজন।

শুধু এই ইনস্টিটিউট নয়, সারা দেশে শিশু হৃদরোগীর জন্য কার্ডিয়াক সার্জন আছেন মাত্র ১২-১৫ জন। যেখানে প্রয়োজন প্রায় ৩০০ জন। সংকট রয়েছে কার্ডিওলজিস্টেরও। পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজিস্টের সংখ্যা ৩০ জনের বেশি নয় বলে জানিয়েছে পেডিয়াট্রিক কার্ডিয়াক সোসাইটি অব বাংলাদেশ (পিসিএসবি)। শুধু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নয়, সংকট আছে আধুনিক অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতির।

দেশে বড়দের হৃদরোগ চিকিৎসায় যুগান্তকারী উন্নতি ঘটেছে। বুক না কেটে সার্জারিসহ হার্টের চিকিৎসায় দারুণ সাফল্য অর্জন করেছেন বাংলাদেশের চিকিৎসকরা। কিন্তু পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজি একেবারে অবহেলিত। শিশুদের হৃদরোগের চিকিৎসায় ঝুঁকি ও পরিশ্রম বেশি কিন্তু অর্থ কম হওয়ায় চিকিৎসকরা তেমন আগ্রহী হন না এ বিষয়ে ডিগ্রি নিতে। আর হাসপাতালগুলোও এ খাতে এত বিনিয়োগ করে না। ফলে সেবাবঞ্চিত হয় শিশু হৃদরোগীরা। চিকিৎসার অভাবে প্রতি বছর প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু হৃদরোগী মারা যায়।

জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের শিশু কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক এবং পিসিএসবির ভাইস প্রেসিডেন্ট ডা. আবদুস সালাম বলেন, ‘দেশে শিশু হৃদরোগ চিকিৎসা এখনো বিকশিত হয়নি, কারণ এটি লাভজনক নয়। অধিকাংশ শিশু হৃদরোগী গরিব। চিকিৎসকরা এ বিষয়ে আসতে চান না কারণ এখানে আয় কম, বড়দের হার্টের চিকিৎসায় আয় বেশি। আরেকটি কারণ হলো অবকাঠামো। চিকিৎসকদের কাজ করতে গেলে কার্ডিয়াক ক্যাথল্যাব, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি প্রয়োজন হয়। কিন্তু এগুলো আমাদের দেশে অপ্রতুল। বিনিয়োগকারীরা এদিকে আসতে চান না কারণ লাভ কম। শিশুদের জন্য দক্ষ নার্স ও স্টাফ নেই। শিশুদের জন্য ডেডিকেটেড আইসিইউ নেই। দেশে হৃদরোগে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বাড়ছে। বর্তমানে প্রায় ৪ লাখ শিশু বিভিন্ন ধরনের হৃদরোগে ভুগছে। তাদের বেশির ভাগেরই জন্মগত হৃদরোগ (সিএইচডি) ধরা পড়েছে। চাইল্ড হার্ট ট্রাস্ট বাংলাদেশের মতে প্রতি ১ হাজার শিশুর মধ্যে অন্তত ২৫ জন সিএইচডি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। নবজাতক শিশুদের অন্তত ২ দশমিক ৫ শতাংশ সিএইচডিতে ভুগছে। বাংলাদেশে মাত্র সাতটি প্রতিষ্ঠান শিশুদের বিভিন্ন হৃদরোগের চিকিৎসা দিয়ে থাকে। সেগুলো হলো- জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ঢাকা শিশু হাসপাতালে শিশুদের কার্ডিওলজি বিভাগ, ইবনে সিনা হাসপাতাল, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) ঢাকা, এবং ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট। এর মধ্যে শুধু হার্ট ফাউন্ডেশন ও সিএমএইচ-এ নবজাতকদের সার্জারির ব্যবস্থা আছে। এ দুই হাসপাতালে শিশু রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতি আছে। শিশুদের হৃদরোগের কারণ জেনেটিক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। যে কোনো ধরনের জন্মগত ত্রুটি, সংক্রমণে ভুগছেন গর্ভবতী মহিলা, রুবেলা ভাইরাসে আক্রান্ত মায়েরা, তেজস্ক্রিয়তা এবং পরিবেশ দূষণের কারণে শিশুদের সিএইচডি হতে পারে। গর্ভধারণের আগে সিএইচডি, এমএমআর ভ্যাকসিন, ভাইরাল আক্রমণ থেকে যে কোনো সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা, পর্যাপ্ত বিশ্রাম, সুষম খাবার, নিয়মিত আল্ট্রাসাউন্ড চেকআপ এবং গর্ভধারণের পর ভ্রƒণের ইকোকার্ডিওগ্রাফি করে নারীদের হার্টের অবস্থা পরীক্ষা করা প্রয়োজন। শিশু হৃদরোগীদের চিকিৎসায় জনবল তৈরির জন্য পিসিএসবি কাজ করছে। পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজির এমডি ও এফসিপিএস কোর্স চালু করা হয়েছে। তবে উদ্যোগের অভাবে সার্জারির কোর্স চালু করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক ডা. আবদুস সালাম। সার্জনরা পেডিয়াট্রিক ডেডিকেটেড কার্ডিয়াক সার্জন হতে আগ্রহী নন। কারণ সরকারি কাঠামোতে পেডিয়ার্ক সার্জনের আলাদা কোনো পদ নেই। দেশে শিশু মৃত্যুর হার কমিয়ে সরকারকে পেডিয়াট্রিক কার্ডিয়াক চিকিৎসায় গুরুত্ব দিতে হবে। চিকিৎসকের পদ সৃষ্টি, কোর্স কারিকুলাম বাড়ানো ও ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজগুলোয় শিশুদের হৃদরোগের চিকিৎসা শুরুর আহ্বান জানান ডা. আবদুস সালাম।

গত বছর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণাঙ্গ শিশু কার্ডিওলজি ও শিশু কার্ডিয়াক সার্জারি ইউনিট গড়ে তুলতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গত বছরের জুলাই থেকে সেখানে সীমিত পরিসরে চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ভারত থেকে বিশেষজ্ঞ সার্জন এসে বিএসএমএমইউতে জটিল শিশু হৃদরোগীদের সার্জারি করছে। বিএসএমএমইউ-এর শিশু কার্ডিওলজি ও শিশু কার্ডিয়াক সার্জারি ইউনিট পুরোপুরি চালু হলে শিশু হৃদরোগীদের ভোগান্তি কিছুটা কমবে বলে মনে করছেন শিশু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা।

সর্বশেষ খবর