শুক্রবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

শীত আসতেই বাড়ছে বিষ

করুণ অবস্থা বুড়িগঙ্গা-তুরাগের, মাটি পানি মাছে মাত্রাতিরিক্ত মাইক্রোপ্লাস্টিক ভারী ধাতু

শামীম আহমেদ

শীত আসতেই বাড়ছে বিষ

বুড়িগঙ্গা নদীর পানি দূষণে কালো হয়ে গেছে। আসে দুর্গন্ধ -বাংলাদেশ প্রতিদিন

‘আগামী মার্চের মধ্যে স্বচ্ছ টলমলে হয়ে উঠবে বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকা ঘিরে থাকা চার নদীর পানি। নদীতে আর পড়বে না শিল্পের বিষাক্ত রঙিন বর্জ্য। দূষিত কালচে পানির উৎকট গন্ধে নাকে রুমাল চাপতে হবে না কারও। পাল তুলে চলা নৌকার পাশাপাশি টলমলে পানিতে ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে চলবে নানা প্রজাতির মাছ।’ গত মার্চে দেশবাসীকে এমন স্বপ্নের কথাই জানিয়েছিল জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। তবে মার্চ আসতে মাত্র সাড়ে তিন মাস বাকি থাকলেও নদীগুলোর দূষণ কমেনি একচুলও। উল্টো শীত আসতেই ঘন ও কালচে হয়ে উঠেছে নদীর পানি। বেড়েছে দুর্গন্ধ।

বহুবার উদ্যোগের পরও স্যুয়ারেজ লাইন দিয়ে কারখানার রাসায়নিক মিশ্রিত বিষাক্ত রঙিন পানি নদীতে পড়া বন্ধ হয়নি। নদীপাড়ের বাসিন্দাদের গৃহস্থালি ও মানববর্জ্য আগের মতোই পড়ছে নদীতে। বর্ষায় নদীগুলোর পানি কিছুটা পরিষ্কার থাকলেও শীত আসতেই হয়ে ওঠে ঘন, কালচে ও দুর্গন্ধযুক্ত। গত দুই দিন বুড়িগঙ্গা ও তুরাগের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দূষণের ভয়াবহ চিত্র চোখে পড়েছে। পানি কমে যাওয়ায় দৃশ্যমান হয়েছে স্যুয়ারেজ লাইনগুলো। সেখান দিয়ে বিরামহীন নদীতে পড়ছে শিল্প ও পয়ঃবর্জ্য মিশ্রিত বিষাক্ত পানি। কালো হয়ে গেছে নদীর পানি। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ১৭ মার্চের মধ্যে ঢাকার চার নদী দূষণমুক্তের ঘোষণা দিয়েছিলাম। এখনো তিন মাসের বেশি আছে। কাজ চলছে। তবে যেভাবে হওয়ার কথা, সেভাবে হয়নি। তহবিলের সংকট আছে। এ ছাড়া অন্য নদীগুলোর সমস্যাও দেখছি। মেঘনা নদী সম্পূর্ণভাবে বালু সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রক্ষা করেছি। পটুয়াখালীতে নদী উদ্ধারে কমিটি যাচ্ছে। কর্ণফুলী উদ্ধারে কমিটি যাচ্ছে। আমরা রাত-দিন কাজ করছি। নদী রক্ষার কাজে এখন কুষ্টিয়ায় অবস্থান করছি। ঢাকার চার নদী দখল ও দূষণমুক্ত করা কোনো স্বপ্ন নয়, এটা কার্যক্রম। নদীর শত্রু অনেক। অনেক ধরনের বাধা আছে। আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

এদিকে গত অক্টোবরে আন্তর্জাতিক জার্নাল সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্টে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গা নদীর মাটি, পানি, মাছ, শামুক এবং কাঁকড়াতে বিপজ্জনক মাত্রায় ক্ষতিকর মাইক্রোপ্লাস্টিক ও ভারী ধাতুর উপস্থিতি রয়েছে। এগুলোতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের পরিমাণ যথাক্রমে পানিতে ০.১২-০.২৫ টি/মিলিলিটার, মাটিতে ৩.৫-৮.১৭ টি/গ্রাম, মাছে ০.৬৫-৩.৮২ টি/গ্রাম, শামুকে ৩.৭৫-৪.২৮ টি/গ্রাম এবং কাঁকড়াতে ০.৮৪-১.১২ টি/গ্রাম। এ ছাড়া প্রতি কেজি মাটিতে আর্সেনিক ৩৭.৬৮ মিলিগ্রাম, ক্রোমিয়াম ১৫৩ মিলিগ্রাম, ক্যাডমিয়াম ৮.৩২ মিলিগ্রাম ও লেড পাওয়া গেছে ৮৭.১২ মিলিগ্রাম। একইভাবে প্রতি লিটার পানিতে আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম, কেডমিয়াম ও লেডের উপস্থিতি ছিল যথাক্রমে ৩৬.৬২ মাইক্রোগ্রাম, ১৪৬.৬৬ মাইক্রোগ্রাম, ৮.১৬ মাইক্রোগ্রাম ও ৮১.৭২ মাইক্রোগ্রাম। গবেষক দলের প্রধান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এবারের গবেষণায় মাইক্রোপ্লাস্টিক যে পরিমাণ ধরা পড়েছে তা বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশের গবেষণা থেকে অনেক বেশি ছিল। ভারী ধাতুও পূর্ববর্তী গবেষণাগুলো থেকে অনেক বেশি পাওয়া গেছে। এসব মাইক্রোপ্লাস্টিক ও ভারী ধাতু স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হয়ে উঠতে পারে। খাদ্য জালের মাধ্যমে এগুলো শরীরে প্রবেশ করে কোষ ক্ষতিগ্রস্ত, ইমিউনোলজিক্যাল পরিবর্তন, জিনোটক্সিসিটি, এন্ডোক্রাইনে ব্যাঘাত, নিউরোটক্সিসিটি, প্রজনন অস্বাভাবিকতা, আচরণগত পরিবর্তন সাধন করে। সরেজমিন বুড়িগঙ্গা নদীর বাবুবাজার ব্রিজ থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যে অন্তত ১৪টি স্যুয়ারেজ লাইনের দেখা পাওয়া গেছে, যেগুলো থেকে রঙিন পানি নদীতে পড়তে দেখা গেছে। এ ছাড়া নদীর পাড়ে বিভিন্ন স্থানে চোখে পড়েছে বর্জ্যরে স্তূপ। বসিলা ও টঙ্গী এলাকায় ভয়াবহ দূষণের চিত্র দেখা গেছে তুরাগ নদে। কালো হয়ে গেছে পানি। দুর্গন্ধে নদীর কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা কষ্টকর। মাঠ পর্যায়ের জরিপ, জিপিএস মানচিত্র ও স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণ করে ২০১৯ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে বুড়িগঙ্গায় ২৩৭টি বর্জ্যরে ভাগাড় ও ২৫১টি স্যুয়ারেজ লাইন এবং তুরাগ নদে (টঙ্গী খালসহ) ১৩১টি বর্জ্যরে ভাগাড় ও ৯৯টি স্যুয়ারেজ লাইন পায় জরিপকারী সংস্থা রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্স সেন্টার (আরডিআরসি)। সংস্থাটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা নিয়মিত নদীগুলো পর্যবেক্ষণ করছি। একটি স্যুয়ারেজ লাইনও বন্ধ হয়নি। এগুলো থেকে মানববর্জ্যসহ কলকারখানার অপরিশোধিত রঙিন পানি বের হওয়াও বন্ধ হয়নি। ডাস্টবিন না থাকায় নদীপাড়ের বাসিন্দারা নদীতেই আবর্জনা ফেলছে। এদিকে বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদফতরের ‘টুওয়ার্ডস অ্যা মাল্টিসেক্টরাল অ্যাকশন প্ল্যান ফর সাসটেইনেবল প্লাস্টিক ম্যানেজমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক সমীক্ষায়  দেখা গেছে, ঢাকার চার নদীতে দৈনিক ১১২ টন বর্জ্য ফেলা হচ্ছে, যার বড় একটি অংশ প্লাস্টিক ও পলিথিন। ২০১৯ সালের নভেম্বর থেকে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত চলে ওই সমীক্ষা।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর