শনিবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা
রাজস্ব আয় বাড়াতে সাত নির্দেশনা দিয়ে মেয়রদের চিঠি

রাজনীতির ফাঁদে পৌরকর

উবায়দুল্লাহ বাদল

রাজনীতির ফাঁদে পৌরকর

ঢাকা বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ একটি পৌরসভা ২০০৮ সালে প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত হয়। ওই সময়ই নতুন করে নির্ধারণ করা হয় পৌরকর। এরপর নতুন করে পৌরকর নির্ধারণ করা হয়নি। ১৫ বছর আগের নির্ধারণ করা করই আদায় করছে পৌর কর্তৃপক্ষ। অথচ বিদ্যমান পৌর আইন অনুযায়ী প্রতি পাঁচ বছর পর পৌরকর নির্ধারণ করার কথা বলা হয়েছে। দেশের অধিকাংশ পৌরসভায় তা মানা হচ্ছে না। এর কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনীতির ফাঁদে পৌরকর বৃদ্ধি ও আদায় আটকে থাকে। কর বাড়ানো হলে ভোটের সময় এর মাশুল গুনতে হয় মেয়র-কাউন্সিলরদের। এ কারণেই মূলত কর বৃদ্ধি-সংক্রান্ত আইন ও বিধান মানতে অনীহা সংশ্লিষ্টদের।

এমন পরিস্থিতিতে দেশের পৌরসভাগুলোকে পাঁচ বছর পরপর কর নির্ধারণ করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সঠিক নিয়মে কর নির্ধারণ করা হচ্ছে কি না তা তদারকির জন্য কাউন্সিলর ও পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমন্বয়ে ওয়ার্ডভিত্তিক কমিটি গঠন করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া কর আদায়ের ক্ষেত্রে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে শহরের মতো পৌরসভাগুলোতেও প্রতিবছর ‘কর মেলা’র আয়োজন করাসহ সাত দফা নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। দেশের পৌরসভাগুলোর রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করার নির্দেশনা দিয়ে মেয়র/প্রশাসকদের চিঠি দিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। চিঠিতে বলা হয়- ১. প্রতি পাঁচ বছর পর কর নির্ধারণ নিশ্চিত করতে হবে। ২. সঠিক পদ্ধতিতে বিধি মোতাবেক কর নির্ধারণ করতে হবে। ৩. যথাযথ নিয়মে কর নির্ধারণ হচ্ছে কি না তা তদারকির জন্য কাউন্সিলর ও পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে ওয়ার্ডভিত্তিক কমিটি গঠন করতে হবে। ৪. কর আদায়ের ক্ষেত্রে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে শহরের মতো পৌরসভাগুলোতেও প্রতিবছর ‘কর মেলা’র আয়োজন করতে হবে। ৫. প্রতি অর্থবছরে জনগণ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যাতে কর প্রদান করে সে লক্ষ্যে মোবাইলে মেসেজ, মাইকিং, টিভি স্ক্রলে এ বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে। ৬. সব কর নির্ধারক, সহকারী কর নির্ধারক, আদায়কারী ও সহকারী কর আদায়কারীদের জন্য পর্যায়ক্রমে প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে হবে এবং ৭. পর্যায়ক্রমে অটোমেশনের মাধ্যমে কর আদায় প্রক্রিয়া চালু করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মুহম্মদ ইবরাহিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশে দিন দিন উন্নতি হচ্ছে। মানুষের চাহিদাও বাড়ছে। সে ক্ষেত্রে ফান্ডের চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। যে হারে মানুষের চাহিদা বাড়ছে সে হারে তো সরকারি ফান্ড দেওয়া সম্ভব নয়। সরকারি সেবা পেতে হলে পৌরকরও বাড়াতে হবে। স্বাবলম্বী হতে হবে পৌরসভাগুলোকে। আইন অনুযায়ী প্রতি পাঁচ বছর পর কর নির্ধারণের নিয়ম থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে তা বাস্তবায়ন হয় না। ভোটের রাজনীতি ছাড়াও সরকারি বরাদ্দ পান বলে অনেকে পৌরকর বাড়ান না। তবে এখন থেকে আইন অনুযায়ী পৌরকর নির্ধারণ ও আদায়ের বিষয়টি নিশ্চিত করতে সব মেয়র ও প্রশাসককে চিঠি দেওয়া হয়েছে।’

বর্তমানে দেশের অনেক পৌরসভায় ১০-১৫ বছর আগের নির্ধারণ করা পৌরকর আদায় করা হচ্ছে। নামমাত্র সেই পৌরকরও অনেক সময় আদায় হচ্ছে না। বছরের পর বছর পৌরকর বাকি থাকলেও তা দেখার কেউ নেই। এ কারণে পৌর মেয়রসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাও বাকি থাকছে মাসের পর মাস। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা বিভাগের দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালনকারী একজন মেয়র বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কমবেশি ২২ বছর ধরে তিনি মেয়রের দায়িত্ব পালন করছেন। ২০০৮ সালে তার পৌরসভা প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত হওয়ার পর কর নির্ধারণ করা হয়েছিল। এরপর আর কর বাড়ানো হয়নি। মানুষ এমনিতেই কর দিতে চায় না। এ নিয়ে ভোটের সময় বিপদে পড়তে হয়। কর বাড়ালে প্রতিপক্ষের প্রার্থীরা সেটাকে ইস্যু করে মাঠ গরম করে। এসব কারণেই মূলত পৌরকর বাড়ানো হয়নি। এবার মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে চিঠি এসেছে। এখন না বাড়িয়ে উপায় নেই।’

দেশের পৌরসভাগুলোর আয়-ব্যয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে চলতি বছর ১১ এপ্রিল পৌরসভা আইনে সংশোধনী আনা হয়। সে অনুযায়ী কোনো পৌরসভায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ১২ মাসের বেতন-ভাতা বকেয়া থাকলে সরকার সেই পৌরসভার নির্বাচিত পরিষদ ভেঙে দিতে পারবে। অর্থাৎ সেই পৌরসভার মেয়র ও কাউন্সিলরদের দায়িত্ব থেকে সরে যেতে হবে। পাশাপাশি পৌরসভাগুলোকে প্রতিমাসের ১০ তারিখের মধ্যে আয়-ব্যয়ের হিসাব দিতে কঠোরভাবে নির্দেশ দেয় স্থানীয় সরকার বিভাগ। পৌরসভাগুলো আয় না বাড়াতে পারলে সরকারি সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেওয়ার হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয় মন্ত্রণালয় থেকে। এমনকি বেতন-ভাতা পরিশোধ না হলে কোনো মেয়র বিদেশে প্রশিক্ষণে যেতে পারবেন না বলে নির্দেশ দেওয়া হয়। এতে অনেকটাই শৃঙ্খলার মধ্যে ফিরেছে স্থানীয় সরকারের এই প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে ৩২৮টি পৌরসভার মধ্যে নিজস্ব আয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিচ্ছে ২৯৪টি। তবে এখনো স্বাবলম্বী হতে পারেনি ৩৪টি পৌরসভা। প্রসঙ্গত, কোনো পৌরসভার বার্ষিক রাজস্ব আয় পরপর তিন বছরের প্রতিবছর গড়ে ১ কোটি টাকার বেশি হলে সেটি প্রথম শ্রেণির পৌরসভা। একইভাবে পরপর তিন বছরের প্রতিবছর গড় রাজস্ব ৮০ লাখ টাকার বেশি হলে সেটি দ্বিতীয় শ্রেণির পৌরসভা। আর প্রতিবছর গড় রাজস্ব আয় ৬০ লাখ টাকার বেশি হলে তা তৃতীয় শ্রেণির পৌরসভা। বর্তমানে দেশে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণি মিলিয়ে পৌরসভা রয়েছে ৩২৮টি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর