রবিবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

ঋণের প্রথম কিস্তি মার্চে

♦ ঢাকায় আইএমএফের ডিএমডি ♦ গভর্নর ও অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক আজ ♦ শর্ত পরিপালনে অনেক দূর এগিয়েছে বাংলাদেশ

মানিক মুনতাসির

ঋণের প্রথম কিস্তি মার্চে

বাংলাদেশের ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ প্রস্তাব চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য আগামী মাসের মাঝামাঝি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের বোর্ডে উঠতে পারে। বোর্ডসভার প্রস্তুতি চলছে। বোর্ডে অনুমোদন পেলে প্রথম কিস্তি ছাড়ের আলোচনা শুরু হবে। আগামী মার্চের মধ্যে ঋণের প্রথম কিস্তি পাওয়া যেতে পারে বলে আশা করছে বাংলাদেশ। তবে বোর্ডসভা পেছালে কিস্তির সময়ও পেছাতে পারে। এর আগে বাংলাদেশকে দেওয়া শর্তগুলো পরিপালনের অগ্রগতি দেখতে ঢাকায় এসেছেন সংস্থাটির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহ। তিনি আজ সকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও সন্ধ্যায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করবেন এবং নৈশভোজে অংশ নেবেন রাজধানীর একটি হোটেলে। আগামীকাল (১৬ জানুয়ারি) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর সৌজন্য সাক্ষাৎ ও একটি বৈঠকের কথা রয়েছে। এরই মধ্যে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ প্রস্তাবের বিপরীতে দেওয়া শর্তগুলো পরিপালনে বেশ এগিয়েছে বাংলাদেশ। এরই অংশ হিসেবে তিন দিন আগে বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। এরও আগে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। বাজেটে ভর্তুকি কমানোর বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে কৃষি খাতের ভর্তুকির বিষয়ে সরকার তার আগের অবস্থানেই রয়েছে। এ ছাড়া রাজস্ব খাতের সংস্কার ও ভ্যাট আইন-২০১২ শতভাগ বাস্তবায়নের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমাতেও খেলাপিদের ছাড় দেওয়া হয়েছে। তবে এর বাইরে আর কোনো শর্ত আছে কি না সে বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো কিছু জানানো হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকও এ বিষয়ে কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি। যদিও বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব প্রকাশিত শর্তের বাইরেও হয়তো সরকার ও আইএমএফের মধ্যে কোনো সমঝোতা হয়েছে যা এখনো প্রকাশ করা হয়নি।

এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এটা একটা মন্দের ভালো খবর যে ঋণটা পাওয়া যাবে সংকটকালে। প্রস্তাবটি যত তাড়াতাড়ি বোর্ডে পাস হবে তত তাড়াতাড়ি অর্থ ছাড় হবে। তবে এখানে মূল বিষয় হলো কোনো শর্তই পরিষ্কার নয়। উভয় পক্ষ যেসব সংস্কারের কথা বলেছে সেগুলো তো আসলেই চলমান, কিন্তু এর বাইরে কোনো শর্ত আছে কি না- যেমন প্রথম কিস্তি পাওয়ার আগে কী কী করতে হবে। পরবর্র্তী কিস্তিগুলো পাওয়ার আগে কোন সময় কী করতে হবে সেগুলো তো নির্দিষ্ট করে প্রকাশ করা হয়নি। ফলে এখানে কিছুটা অস্পষ্টতা রয়েছে। আর চলমান সংকট মোকাবিলায় এ ঋণ কতটা কার্যকর হবে বা সংকট কেটে যাবে কি না তা এখনই বলা যাবে না। তবে কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব তো অর্থনীতিতে পড়বেই বলে তিনি মনে করেন। সূত্র জানান, সব ঠিকঠাক থাকলে এ ঋণের প্রথম কিস্তির ৩৫ কোটি ডলার আগামী মার্চে পাওয়া যাবে বলে আশা করছে সরকার। এরপর ধাপে ধাপে আর্থিক খাতের সংস্কারের অগ্রগতি পর্যালোচনা প্রতিবেদনের ওপর কিস্তির অর্থছাড় নির্ভর করবে। চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে অনুষ্ঠেয় আইএমএফের বোর্ডসভায় বাংলাদেশের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হতে পারে। যার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। আইএমএফের এ ঋণ পেতে ভ্যাট আইন-২০১২-এর পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে। রাজস্ব আয় বৃদ্ধি, আর্থিক খাতের নজরদারি বৃদ্ধি, বাংলাদেশ ব্যাংকর স্বাধীনতা, জ্বালানি খাতের ভর্তুকি কমানো, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি কাটাতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করে তোলা, ব্যাংক ঋণ ও আমানতের সুদের হার বাড়ানো, আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী রিজার্ভের হিসাব, নতুন বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নয়নসহ আরও কিছু সংস্কারমূলক কার্যক্রম পরিপালন করতে হবে বাংলাদেশকে।

এদিকে এ ঋণ প্রস্তাবের বিপরীতে দেওয়া শর্তগুলোর পরিপালন, সামগ্রিক বিষয়ে পর্যালোচনা এবং দেখভালের জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দফতরের সমন্বয়ে ২২ সদস্যের একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ কমিটি শর্ত পরিপালনের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও মন্ত্রণালয়গুলোকে সমন্বয় করবে। একই সঙ্গে অগ্রগতি প্রতিবেদন তৈরি করে অর্থ বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করবে। তার সঙ্গে এ ঋণের ফলে দেশের অর্থনীতিতে কী ধরনের ইতিবাচক প্রভাব পড়বে সে বিষয়টিও পর্যালোচনা করবে এ কমিটি।

এর আগে আইএমএফ জানিয়েছিল এ ঋণের প্রথম কিস্তির ৩৫ কোটি ডলার পাওয়া যাবে আসছে ফেব্রুয়ারিতে। বাকি অর্থ ৬৫৯ মিলিয়ন ডলার সমান ছয় কিস্তিতে ২০২৬ সালের মধ্যে পাবে বাংলাদেশ। অবশ্য এ ঋণের কোন শর্ত যুক্ত রয়েছে সরকার-আইএমএফ কোনো পক্ষই তা বলছে না। বলা হচ্ছে, আর্থিক খাতে কিছু সংস্কার আনতে হবে। এমনকি সরকার সেগুলো নিয়ে আগে থেকেই কাজ করছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তবে অর্থ বিভাগ বলছে, প্রথম কিস্তির সময়সীমা নির্ভর করছে বোর্ডসভার ওপর। ফেব্রুয়ারি মাঝামাঝি বোর্ডসভায় অনুমোদিত হলে মার্চেই প্রথম কিস্তি পাওয়া যাবে। জানা গেছে, তিনটি ঋণ কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশ সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার পাচ্ছে। সেগুলো হচ্ছে- এক্সটেনডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি (ইসিএফ), এক্সটেনডেড ফাইন্যান্স ফ্যাসিলিটি (ইএফএফ) এবং রেজিলেন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ)। প্রতিটি ঋণ কর্মসূচির গ্রেস পিরিয়ড ও পরিশোধকাল ভিন্ন ভিন্ন। তবে সব ঋণই মিলবে সাত কিস্তিতে। প্রথম কিস্তি আগামী মার্চে ৪৪৭ দশমিক ৪৮ মিলিয়ন ডলার ছাড় করা হবে। এরপর দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ এভাবে পরবর্তী চার বছরে ছয় কিস্তিতে সমান ৬৫৯ দশমিক ১৮ মিলিয়ন ডলার করে ছাড় করা হবে। ইসিএসফ আওতায় প্রদেয় ঋণে সাড়ে পাঁচ বছর গ্রেস পিরিয়ড পাওয়া যাবে। তার পরবর্তী ১০ বছরে এ ঋণ শোধ করতে হবে। ইএফএফ ঋণ কর্মসূচিতে সাড়ে তিন বছর গ্রেস পিরিয়ড মিলবে। আর পরিশোধ করতে হবে পরবর্তী ১০ বছরে। আরএসএফ ঋণ কর্মসূচিতে পাওয়া যাবে ১০ বছরের গ্রেস পিরিয়ড সুবিধা এবং তা পরিশোধ করা যাবে আগামী ২০ বছরে। এজন্য বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে আইএমএফের এশিয়া অঞ্চলের প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে সংস্থাটির একটি প্রতিনিধি দল গত বছরের ২৬ অক্টোবর থেকে ৯ নভেম্বর বাংলাদেশ সফর করে। সফর শেষে ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে রাহুল আনন্দ বলেন, বাংলাদেশ এ ঋণের জন্য উপযুক্ত।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর