মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা
একুশে পদক প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী

ভাষা আন্দোলনের জন্য বঙ্গবন্ধুকে বারবার কারাবরণ করতে হয়

নিজস্ব প্রতিবেদক

ভাষা আন্দোলনের জন্য বঙ্গবন্ধুকে বারবার কারাবরণ করতে হয়

রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে গতকাল একুশে পদকপ্রাপ্তদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা -পিআইডি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর যে অবদান, সেই অবদানটুকু কিন্তু মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল। অনেক বিজ্ঞজন, আমি কারও নাম বলতে চাই না, চিনি তো সবাইকে। অনেকে বলেছেন, উনার আবার কী অবদান ছিল? জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষা আন্দোলনের জন্য বারবার কারাবরণ করলেও তাঁর অবদান ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে।

গতকাল সকালে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ‘একুশে পদক-২০২৩’ প্রদান অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ও দুটি প্রতিষ্ঠানের মাঝে পদক বিতরণ করেন প্রধানমন্ত্রী। মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, সংসদ সদস্য, ঊর্ধ্বতন বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তা, বিদেশি আমন্ত্রিত অতিথি এবং কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পীসহ দেশবরেণ্য বিশিষ্ট ব্যক্তি ও বুদ্ধিজীবীরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু জেলে ছিলেন বলে উনার কোনো অবদান নেই? তাহলে উনি জেলে ছিলেন কেন? এই ভাষা আন্দোলন করতে গিয়েই তো তিনি বারবার কারাগারে গিয়েছেন। সেই গুরুত্ব কিন্তু কেউ দিতে চায়নি। তিনি বলেন, আমাদের ভাষা মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের আন্দোলন সূচনা করেছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তারই উদ্যোগে ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় এবং আমাদের ভাষার জন্য আন্দোলন শুরু হয় ১৯৪৮ সাল থেকে। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা অর্জন। পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্স ব্র্যাঞ্চের রিপোর্টে বঙ্গবন্ধুর ভাষা আন্দোলনে অবদানের কথা উল্লেখ আছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ইন্টেলিজেন্স রিপোর্টগুলো পাওয়ার পরে আমি একটা ভাষণ দিয়েছিলাম। তখন একজন বিদগ্ধজন আমাকে খুব ক্রিটিসাইজ করে একটা লেখা লিখলেন যে, আমি নাকি সব বানিয়ে বানিয়ে বলছি। তিনি বলেন, গোয়েন্দা রিপোর্টগুলো নিয়ে আমি আর আমার বান্ধবী বেবি মওদুদ, এম আর আক্তার মুকুলের কাছে যাই। মুকুল ভাইকে বললাম, আপনার কাছে এই যে সব রিপোর্ট দিলাম, কোন তারিখে কখন কী করেছেন এখানে সব বিস্তারিত আছে। ফাইলটা দিলাম; আপনি এর জবাবটা লিখুন। তিনি সত্যিই লিখেছিলেন। কারণ, উনারা তো (সমালোচক) অনেক উঁচু মাপের লোক। আমাদের মতো ছোট চুনোপুটিরা কিছু লিখলে তো হবে না, সে জন্য। পরে অবশ্য সেগুলো ১৪ খে র পুস্তক আকারে প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি জাতির পিতার লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও তাঁর ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন ভূমিকার উল্লেখ রয়েছে। ‘বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার একটা প্রবণতা সব সময় ছিল’, উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে হত্যার পর দেখা গেল আমাদের সেই মহান মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান, যে স্লোগান দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে, সেই জয়বাংলা স্লোগান নিষিদ্ধ। ৭ মার্চের ভাষণ, যে ভাষণে গেরিলা যুদ্ধের সমস্ত নির্দেশনা এবং সে ঐতিহাসিক কথা ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, রেডিওতে প্রতিদিন এই বার্তাটা পৌঁছানো হতো। এই ভাষণের কারণে মুক্তিযোদ্ধারা যার যা কিছু ছিল তাই নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন। সেই ভাষণটাও নিষিদ্ধ। আসলে বঙ্গবন্ধুর নামই তো মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে আমাদের আসতে হয়েছে, এখনকার প্রজন্ম যারা অনেক কিছু জানেও না। তিনি বলেন, উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রচেষ্টা, রোমান ও আরবি হরফে বাংলা লেখানোর প্রচেষ্টা এমনকি রবীন্দ্র সংগীতও অন্যদের দিয়ে লেখানোর প্রচেষ্টা বাঙালি দেখেছে, কিন্তু আমরা তখন আন্দোলন করেছি সবাই মিলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্রসহ সারা বাংলাদেশে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে এবং এভাবেই আমাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম আরও দানা বেঁধেছে। আর সেই সংগ্রামের মধ্য দিয়েই আমরা জাতির পিতার নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীনতাও অর্জন করেছি।

ভাষা ও সাহিত্যের ওপর এমন বারবার আঘাত আর কোনো দেশে এসেছে বলে তাঁর জানা নেই উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, অনেক দেশে যুদ্ধের মধ্যেও তাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি চলমান থাকে। ব্রিটিশ এবং ফ্রান্সের মধ্যে সারা জীবন শত্রুতা চললেও তাদের আর্ট, কালচার ও ভাষা-সাহিত্যচর্চা কোনো দিনই বন্ধ ছিল না। কিন্তু, আমাদের পাকিস্তান নামের একই দেশে বাঙালিদের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর বারবার আঘাত এসেছে। তিনি বলেন, কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর থেকেই আমরা সব সময় চেষ্টা করেছি আমাদের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি যেন সুন্দরভাবে বিকশিত হয় এবং আমরা বাঙালি এই বাঙালি হিসেবেই বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে চলব। আমরা বাংলাদেশ পেয়েছি কাজেই এ দেশকে আমরা আর এগিয়ে নিয়ে যাব উন্নয়নের পথে। প্রধানমন্ত্রী একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি অর্জনে কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশি সালাম ও রফিক এবং ‘ভালোবাসি মাতৃভাষা’ নামক সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার উল্লেখ করেন। তাঁদের এবং আওয়ামী লীগ সরকারের জোর প্রচেষ্টাতেই ইউনেস্কো অমর একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি দিয়েছে। তিনি একুশে পদকপ্রাপ্ত গুণীজন সবাইকে তাঁর আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, আমাদের সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমন অনেক গুণীজন রয়েছেন যাদের অনেকে নামটি পর্যন্ত জানে না। এ পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে তাদের অবদানকেই সবার সামনে নিয়ে আসাই তাঁর সরকারের প্রচেষ্টা। এ জন্য সম্মাননাপ্রাপ্তদের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। সরকারপ্রধান বলেন, আমি আশা করি আমাদের নতুন প্রজন্মও এভাবে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখবে। কারণ, গুণীজনদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেই আমাদের দেশকে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

যারা পুরস্কার পেলেন : এ বছর ভাষা আন্দোলন ক্যাটাগরিতে তিনজন, মুক্তিযুদ্ধে একজন, শিল্পকলায় আটজন (অভিনয়, সংগীত, আবৃত্তি, চারু ও চিত্রকলা), রাজনীতিতে দুজন, শিক্ষায় একজন ব্যক্তি ও একটি প্রতিষ্ঠান, সমাজসেবায় একজন ও একটি প্রতিষ্ঠান এবং সাংবাদিকতা, গবেষণা এবং ভাষা ও সাহিত্যে একজন করে একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। ভাষা আন্দোলন ক্যাটাগরিতে খালেদা মঞ্জুর-ই খুদা, বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম শামসুল হক (মরণোত্তর) এবং হাজী মোহাম্মদ মজিবুর রহমান। শিল্পকলা বিভাগে অভিনয় ক্যাটাগরিতে মাসুদ আলী খান ও শিমুল ইউসুফ এবং সংগীত বিভাগে মনোরঞ্জন ঘোষাল, গাজী আবদুল হাকিম ও ফজল-এ-খোদা (মরণোত্তর), আবৃত্তি বিভাগে জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, শিল্পকলায় নওয়াজিশ আলী খান এবং চিত্রকলা বিভাগে কনক চাঁপা চাকমা পুরস্কার পেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ বিভাগে মমতাজ উদ্দিন (মরণোত্তর), সাংবাদিকতায় মো. শাহ আলমগীর (মরণোত্তর), গবেষণায় ড. মো. আবদুল মজিদ, শিক্ষায় অধ্যাপক ড. মযহারুল ইসলাম (মরণোত্তর), সমাজসেবায় মো. সাইদুল হক, অ্যাডভোকেট মঞ্জুরুল ইসলাম (মরণোত্তর) এবং রাজনীতিতে আকতার উদ্দিন মিয়া (মরণোত্তর) এবং ভাষা ও সাহিত্যে ড. মনিরুজ্জামান পুরস্কার পেয়েছেন। শিক্ষা ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর এবং সমাজসেবায় বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন এ পুরস্কার লাভ করেছে। পুরস্কার হিসেবে প্রত্যেককে স্বর্ণপদক, সম্মাননা সনদ এবং ৪ লাখ টাকার চেক প্রদান করা হয়। সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন পদক বিতরণ পর্বটি সঞ্চালনা ও পদক বিজয়ীদের সাইটেশন পাঠ করেন। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবুল মনসুর স্বাগত বক্তৃতা করেন।

 

সর্বশেষ খবর