শনিবার, ৪ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

রাজধানীতে লোকদেখানো খাল উদ্ধার

মাঝে মাঝে অভিযান চলে। কিছুদিন পর যা ছিল তাই হয়ে যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, হাঁটাপথ নির্মাণের মধ্য দিয়ে বন্ধ হতে পারে অবৈধ খাল দখল

হাসান ইমন

রাজধানীতে লোকদেখানো খাল উদ্ধার

রাজধানীর মিরপুর-১৪ নম্বরের বাউনিয়া খালে বর্জ্য জমে স্বাভাবিক পানিপ্রবাহে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছে। পানিতে ময়লা মিলে উৎকট গন্ধ ছড়াচ্ছে চারদিকে। ভোগান্তিতে পড়েছেন এলাকার মানুষ। ছবিটি গতকাল তোলা -জয়ীতা রায়

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তালিকাভুক্ত খাল ২৬টি। ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা ওয়াসা থেকে সিটি করপোরেশন এসব খালের দায়িত্ব বুঝে নেয়। এরপর শুরু হয় খাল পরিষ্কার অভিযান। ওই সময় ঘোষণা ছিল পরিষ্কারের পাশাপাশি অবৈধ দখলও উচ্ছেদ করা হবে। এরপর দুই বছরের বেশি সময়ে খাল উদ্ধারে বিভিন্ন কর্মসূচির শুধু ঘোষণাই দিয়ে গেছেন দুই মেয়র, কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি। শুধু তাই নয়, খালের সীমানাও নির্ধারণ করতে পারেনি সংস্থা দুটি। এ ছাড়া এ সময়ে শুধু খাল পরিষ্কার অভিযানেই সীমাবদ্ধ ছিল করপোরেশন দুটি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীতে খাল রয়েছে ৬৯টি। এর মধ্যে ঢাকা ওয়াসা সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করেছে ২৬টি। খাল হস্তান্তরের আড়াই বছর হতে চলল। এখন পর্যন্ত একটি খালও উদ্ধার করতে পারেনি সিটি করপোরেশন। বিভিন্ন সময় লোক দেখানো উচ্ছেদ অভিযান চলেছে। এখন তা আবার পুরনো রূপে ফিরেছে। খালগুলো উদ্ধার করতে হলে আগে জরিপ ও সীমানা নির্ধারণ করতে হবে। এরপর উদ্ধার করে হাঁটার পথসহ সৌন্দর্যবর্ধন করতে হবে। তাহলেই খাল উদ্ধার টেকসই হবে।

জানা যায়, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় তালিকাভুক্ত রয়েছে কাঁটাসুর, হাজারীবাগ, ইব্রাহিমপুর, কল্যাণপুর, আবদুল্লাপুর, রামচন্দ্রপুর, বাউনিয়া, দ্বিগুণ, দিয়াবাড়ী, ধোলাইখাল, রায়েরবাজার, বাইশটেকি ও শাহজাহানপুর খাল। আর দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় রয়েছে, জিরানী, মান্ডা, মেরাদিয়া, গজারিয়া, কসাইবাড়ী, শাহজাদপুর, সুতিভোলা, ডুমনি, বোয়ালিয়া, রামপুরা, গোবিন্দপুর, সেগুনবাগিচা ও খিলগাঁও-বাসাবো খাল। এসব খালের একটিও উদ্ধার করতে পারেনি দুই সিটি করপোরেশন। তবে ২০২১ সালের শুরুতে মোহাম্মদপুরের বসিলায় লাউতলা খাল উদ্ধার করে রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন ডিএনসিসি মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। ওই সময় গণমাধ্যমকে তিনি বলেছিলেন, প্রতিটি খালে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা সব স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে। সে ঘোষণার পর পেরিয়েছে দুই বছরের বেশি। কিন্তু এখনো আর একটি খালও অবৈধ দখলমুক্ত করা যায়নি। উদ্ধার করা লাউতলা খালটি ডিএনসিসির তালিকার বাইরে।

এর আগে ২০২১ সালের ৪ জানুয়ারি ইব্রাহিমপুর খালে উচ্ছেদ অভিযান চালায় সংস্থাটি। ওই সময় বাধার সম্মুখীনও হয়। কয়েকদিন উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করলেও পুরো খালটি দখলমুক্ত হয়নি।

এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ২০২১ সালের শুরুতে জিরানি খালে অভিযান চালায়। ওই সময় কয়েকটি অবৈধ দোকান, লোহার ও বাঁশের ব্রিজ এবং কিছু অবৈধ স্থাপনা ভেঙে ফেলা হয়। আর ফেব্রুয়ারিতে মান্ডা ও শ্যামপুর খালে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়। ওই অভিযানেও কয়েকটি অবৈধ দোকান ও বাড়ি উচ্ছেদ করা হয়। একই বছরের অক্টোবরে কালুনগর খালে অভিযান পরিচালনা করে ডিএসসিসি। ওই অভিযানে কিছু অবৈধ স্থাপনাও উচ্ছেদ করা হয়। একই সঙ্গে গত বছরের ৩০ মার্চ মাইশা খালে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়। ওই সময় কিছু অবৈধ স্থাপনাও উচ্ছেদ করে সংস্থাটি। আরও কয়েকটি খালে অভিযান পরিচালনা করা হয়। কিন্তু খালগুলো সম্পূর্ণ উদ্ধার করা হয়নি। তবে সাগুফতা, রামচন্দ্রপুর, ইব্রাহিমপুর, গোদাগারি, রূপনগর এবং মান্ডা, জিরানি, কালুনগর, শ্যামপুর, খিলগাঁও-বাসাবোসহ প্রায় সব খাল থেকে বর্জ্য অপসারণ করে দুই সিটি করপোরেশন।

রাজধানীর খাল নিয়ে একাধিক গবেষণা করেছে রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি)। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, খাল উদ্ধার করতে হলে সবার আগে প্রয়োজন খাল জরিপ করা। খালের সীমানাও নির্ধারণ করতে হবে। এরপর হবে খাল উদ্ধার। সিটি করপোরেশন খাল বুঝে পাওয়ার পর দুই বছরের বেশি সময় পার হয়েছে, একটি খালেরও সীমানা নির্ধারণ করতে পারেনি। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের কাছে ২৬টি খাল রয়েছে। সব একসঙ্গে উদ্ধার করে উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া কঠিন। সে জন্য আগে একটি খাল নির্দিষ্ট করে উদ্ধার ও উন্নয়নের পরিকল্পনা নিলে সেটা সহজ হবে। একটি একটি করে খাল উদ্ধার ও উন্নয়নে প্রকল্প নিলে সেটা টেকসই হবে।

এ বিষয়ে ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শ্যামপুর, মান্ডা, জিরানী ও কালুনগর খালের বর্জ্য ও পলি অপসারণ এবং সংস্কার করে নান্দনিক পরিবেশ গড়ে তুলতে ৮৯৮ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে। এ চারটি খালের নকশা, অঙ্কন ও জরিপ কাজ চলছে। এসব খাল থেকে বর্জ্য অপসারণ ও ভূমি উন্নয়নে দরপত্র আহ্বানের কার্যক্রমও চলছে। তিনি আরও বলেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নিজস্ব অর্থায়নে বুড়িগঙ্গা আদি চ্যানেলসহ কুতুবখালী, জিয়া সরণি, মৃধাবাড়ি, তিতাস, কাজলা, খিলগাঁও-বাসাবো এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে সংলগ্ন খাল ও শাখা-খাল থেকে বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রম চলছে। আদি বুড়িগঙ্গা চ্যানেল ঘিরে কার্যক্রম বাস্তবায়নে ডিপিপি প্রণয়নের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের কাজও এগিয়ে চলেছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, আমরা ইতোমধ্যে অনেক খালে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেছি। প্রায় সব খাল পরিষ্কার করা হয়েছে। তবে এখনো সব খালে থাকা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে সক্ষম হইনি। তিনি বলেন, খালের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে সীমানা নির্ধারণ করতে হবে। এখন সে কাজ চলছে। এ ছাড়া সীমানা নির্ধারণে কিছু জটিলতা তৈরি হয়েছে। এসব নিরসন করে কাজ শুরু হবে।

সরেজমিন দেখা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নন্দীপাড়া (জিরানি) খাল। অনেক বড় এ খালটি দূষণ আর দখলের কবলে মৃতপ্রায়। এর মাদারটেক অংশে খালের মধ্যে খুঁটি পুঁতে বিপুলসংখ্যক দোকান বসানো হয়েছে। এসব বাঁশের খুঁটিতে ময়লা আটকে স্তূপ হয়ে আছে। বাগানবাড়ী-মাদারটেক এলাকায় ওয়াসা পানির পাম্পের পাশে খালের অবস্থা খুবই করুন। সেখানে খালে ময়লার স্তূপ দেখা গেছে। এ বিষয়ে কথা হয় স্থানীয় দোকানদার জেনারেল স্টোরের কর্ণধার মো. রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ২০২১ সালে খালটি পরিষ্কার করে সিটি করপোরেশন। অথচ এখন মনে হচ্ছে কোনোদিন পরিষ্কার করা হয়নি। খাল ভরাটের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আশপাশের কিছু মানুষ পাম্পের পাশে ময়লা ফেলে, এসব ময়লা খালে যাচ্ছে।  রাজধানীর রামপুরা-বনশ্রী খালের অবস্থাও নাজুক। এ খালে অবৈধ দখল তুলনামূলক কম থাকলেও দূষণের ফলে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। খালটির মেরাদিয়া বাজার অংশে বিশাল ময়লার ভাগাড় রয়েছে। সেখানে ময়লা ফেলার সেকেন্ডারি ট্রান্সপার স্টেশন (এসটিএস) থাকলেও তা অনেকদিন ধরে নষ্ট। এ এসটিএসের সামনে খালের পাড়ে বনশ্রী ও দক্ষিণ বনশ্রী এলাকার বাসাবাড়ির ময়লা ফেলা হচ্ছে। সেখানের কিছু ময়লা ল্যান্ডফিল্ডে নিলেও অধিকাংশ খালে পড়ছে। এর বনশ্রী ডি-ব্লক অংশে মূল সড়কের পাশে খালপাড়ে ময়লা ফেলা হচ্ছে। এসব ময়লা খালে পড়ছে। মান্ডা খালের অবস্থা আরও নাজুক। গুদারাঘাট এলাকায় মান্ডা সেতুর দুই পাশে যতদূর চোখ যায়, শুধুই ময়লার স্তূপ। কিছু অংশ দখল করে গোয়াল ঘর, দোকান, আবাসিক ভবনসহ নানা স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। খিলগাঁও-বাসাবো খালের অস্তিত্ব বাসাবো অংশে চোখে পড়লেও খিলগাঁও অংশে হারিয়ে গেছে। খিলগাঁও রেলক্রসিং থেকে তালতলা মার্কেটের দিকে যেতে ঢাকা ওয়াসার পিলার থাকলেও সেখানে খালের চিত্র পাওয়া যায় না। খাল ভরাট করে মাটির নিচ দিয়ে পাইপ ড্রেন তৈরি করা হয়েছে।

এদিকে মহাখালী বাসস্ট্যান্ডের কাছের খালটি উদ্ধারের পরও এতটাই সংকুচিত যে পানির প্রবাহ নেই বললেই চলে। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, এটাকে খাল বলার উপার নেই। নালার মতো পড়ে আছে। একই অবস্থা মোহাম্মদপুরের কাঁটাসুর, রূপনগর, ইব্রাহিমপুর, সাংবাদিক কলোনি, কল্যাণপুর ও লাউতলা খালের।

সর্বশেষ খবর