শুক্রবার, ১০ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

অটোরিকশার জন্য খুন বাড়ছেই

প্রতি বছর হত্যার শিকার কয়েক ডজন চালক

শামীম আহমেদ

অটোরিকশার জন্য খুন বাড়ছেই

অটোরিকশা ছিনতাইয়ের জন্য খুনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। যাত্রীবেশী ছিনতাইকারীর হাতে হরহামেশা প্রাণ দিতে হচ্ছে অটোচালকদের। কখনো শুধু অটোরিকশার ব্যাটারির জন্য নির্মমভাবে খুন করা হচ্ছে চালককে। বন্ধুর হাতে বন্ধু খুনের ঘটনাও ঘটছে। গত এক দশকে দেশে ছিনতাইকারীদের হাতে শুধু ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও ইজিবাইকচালক খুন হয়েছেন ৩ শতাধিক। এর বাইরে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ভাড়ায়চালিত প্রাইভেটকার, পিকআপ ও মোটরসাইকেল ছিনতাইয়ের জন্যও ঘটছে হত্যাকাণ্ড। এসব ঘটনায় কিছু অপরাধী গ্রেফতার হয়ে সাজা পেলেও অধিকাংশই রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, খুন হওয়া চালকদের অধিকাংশ ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। কেউ অটোরিকশা ভাড়ায় নিয়ে চালাতেন, কেউ ঋণ করে কিনেছিলেন অটোরিকশা বা ইজিবাইক। পরিবারের আহার জোগাতে অটোরিকশা নিয়ে বের হচ্ছেন চালক, এক-দুই দিন পর তার লাশ মিলছে ধানখেত, ডোবা, নালা, খাল বা রাস্তার পাশে। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে বিপাকে পড়েছে পরিবারগুলো। সেই চুরি যাওয়া অটোরিকশার জন্য অনেক পরিবারকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে ঋণের বোঝা। হত্যার শিকার অনেক অটোচালকের বয়স ১৫ বছরের কম। সম্প্রতি মামলা-সংক্রান্ত তদারক সেলের বৈঠকেও এই অপরাধ মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হওয়ায় উদ্বেগ জানানো হয়।

এদিকে বছর দুয়েক আগে ঢাকায় আতঙ্ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল ‘গামছা পাটি’। গলায় গামছা পেঁচিয়ে যানবাহনের চালক ও যাত্রীদের হত্যা করে ছিনতাই করত তারা। ২০২০ সালের শুরু থেকে ২০২১ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত গামছা পার্টির হাতে প্রাণ দেন অন্তত ১৬ জন। সহজে ব্যাটারি বিক্রি ও আলাদা করে যন্ত্রাংশ বিক্রির সুযোগ থাকায় বর্তমানে ছিনতাইকারীদের প্রধান টার্গেট অটোরিকশা ও ইজিবাইক। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলাতেই গত পাঁচ বছরে ১৭ জন ইজিবাইকচালক খুন হয়েছেন। এ ছাড়া ১৮৮টি ইজিবাইক ও অটোরিকশা ছিনতাই হয়েছে বলে জানা গেছে। এসব হত্যাকাণ্ডে গ্রেফতারকৃতদের তথ্যমতে, সারা দেশেই বিস্তৃত তাদের সিন্ডিকেট। আর একটা খুনের বিনিময়ে পাওয়া অটোরিকশাটি বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকায়। অনেক ঘটনা দারিদ্র্য বা মাদকাসক্তির কারণেও ঘটছে।

পুলিশ ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্যান্য সংস্থাও এসব ঘটনার তদন্ত করছে। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা এ ধরনের শতাধিক মামলার তদন্ত করছি। তাতে দেখেছি, এসব খুনের ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্থানীয় লোকজন জড়িত। কিছু আন্তজেলা চক্র আছে। তবে দীর্ঘদিন ধরে অনেক খুনের সঙ্গে জড়িত এমন চক্র তেমন পাইনি। যশোরে সম্প্রতি একজনকে গ্রেফতার করেছি, যে আগেও খুন করে সিএনজি ছিনতাই করেছিল। পিবিআইর হাতে গ্রেফতার হয়ে জেলে যায়। এক বছর পর জেল থেকে বের হয়ে জামিনের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে আবার খুন করেছে। সারা দেশেই এমন ঘটনা ঘটছে। কেন এগুলো বাড়ছে, গবেষণা হওয়া উচিত। তিনি বলেন, এখানে শুধু খুন হওয়াটাই সমস্যা নয়, অধিকাংশ অটোরিকশা ঋণের টাকায় কেনা। ফলে চালকের মৃত্যুর পরও ওই দরিদ্র পরিবারটিকে ঋণের বোঝা টানতে হয়। এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) গত বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ১৫১টি চোরাই গাড়ি উদ্ধার করেছে। এর মধ্যে ১৪টি সিএনজিচালিত অটোরিকশা। ডিবিপ্রধান হারুন অর রশিদ জানিয়েছেন, বেশ কিছু মামলার ছায়াতদন্ত হচ্ছে। হত্যার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। বেশ কয়েকজন গ্রেফতারও হয়েছে।

রোমহর্ষক কিছু খুনের ঘটনা : নরসিংদীর শীলমান্দিতে গত ২২ ফেব্রুয়ারি অটোরিকশাচালক টুটুলকে ছুরিকাঘাত ও গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করে অটোরিকশাটি ছিনতাই করে তারই ঘনিষ্ঠ বন্ধু খোরশেদ আলম। পরে পুলিশ দুই সহযোগীসহ খোরশেদকে গ্রেফতার করে। গত ৯ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারে একটি সুপারি বাগানে মেলে অটোচালক মোরশেদ আলমের ক্ষতবিক্ষত লাশ। ১৮ ফেব্রুয়ারি খুনের আলামতসহ দুজনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। ৫ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের কালিয়াকৈরের বেলাবহ এলাকার নির্জন স্থানে পাওয়া যায় অটোচালক আজাদ শেখের গলা কাটা লাশ। ৬ জানুয়ারি ফেনী সদর উপজেলার ফরহাদনগরে অটোরিকশাচালক মো. আবুল হোসেন কালা মিয়াকে হত্যা করে অটোরিকশা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় তিনজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তারা আগেও একইভাবে অটোরিকশা ছিনতাই করেছে।

সদ্য শেষ হওয়া বছরেও চালককে হত্যা করে অটোরিকশা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে কয়েক ডজন। ২৬ ডিসেম্বর দিনাজপুরের হিলিতে অটোচালক মফিজার রহমান খুন হন। ২৫ ডিসেম্বর নোয়াখালীর কবিরহাটে খুন হন মেসবাহ উদ্দিন রাব্বি। ১৩ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জ শহরে খুন হন অন্তর নামের এক প্রতিবন্ধী অটোচালক। রাজধানীতে গত ৮ ও ২৫ ডিসেম্বর একই কায়দায় মো. মোস্তফা ও জিহাদ নামে দুই চালককে খুন করে অটোরিকশা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। পরে ওই ঘটনায় জড়িত ছিনতাইকারী চক্রের ছয় সদস্যকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। জানা যায়, চক্রটির সদস্যদের বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগরী ও আশপাশের জেলার বিভিন্ন থানায় হত্যা, গুম ও ছিনতাই ঘটনায় আরও মামলা রয়েছে। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে গত ৩০ নভেম্বর পাওয়া যায় অটোচালক মনির মিয়ার রক্তাক্ত লাশ। ২ নভেম্বর রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ফুটপাতে অচেতন অবস্থায় পড়ে ছিলেন সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক মোক্তার হোসেন। হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। ৩১ অক্টোবর ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে ঝোপ থেকে নাছির উদ্দিন নামে অটোচালকের লাশ উদ্ধার হয়। ২০ অক্টোবর ময়মনসিংহের ভালুকায় অটোচালক মোফাজ্জল হোসেনের লাশ উদ্ধার হয়। একই দিনে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে ডোবায় মেলে অটোচালক মাহাবুল আলম মহিনের লাশ। ১২ অক্টোবর পাবনার চাটমোহরে ধানখেতে পাওয়া যায় অটোচালক ইসমাইল হোসেনের লাশ। ২৫ সেপ্টেম্বর নরসিংদীর রায়পুরায় কলা বাগানে সিমেন্টের খুঁটির সঙ্গে বাঁধা অটোচালক বিজয় মিয়ার লাশ পাওয়া যায়। ৬ সেপ্টেম্বর সাভারে সড়কের পাশে পাওয়া যায় অটোচালক নাসির হোসেনের গলা কাটা লাশ। ২৯ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে মেলে অটোচালক রোকন উদ্দিনের গলা কাটা লাশ। একই দিনে বগুড়ার দুপচাঁচিয়ায় ধানখেত থেকে উদ্ধার হয় অটোভ্যানচালক হারুনের লাশ। এক কিলোমিটার দূরে একটি বাগানে তার অটোভ্যানটি পড়ে থাকলেও ছিল না ব্যাটারি। একইভাবে গত বছর রাজধানীর কুর্মিটোলা বিহারি ক্যাম্পের সামনের সড়কে মেলে অটোচালক লতিফ হাওলাদারের গলা কাটা লাশ। গাজীপুরের শ্রীপুরে হাবিবুর রহমান দুখু, আনোয়ার হোসেন, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে মোজাম্মেল হক, ফরিদপুরের মাচ্চর ইউনিয়নে সাব্বির বিশ্বাস, গাজীপুরের কালিয়াকৈরে মনিরুল ইসলাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরে মোহাম্মদ শরীফ, নওগাঁর মহাদেবপুরে হাসান আলী, গাজীপুরের কাশিমপুরে হুমায়ূন কবির, ময়মনসিংহের নান্দাইলে আ. মন্নাফসহ আরও অনেক অটোচালক খুন হন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর